ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দীর্ঘ দমনপীড়নের শাসনামলে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন এবং তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে প্রতিহিংসাবশত বছরের পর বছর কারাগারে আটক রাখা হয়। অনেকের মতে, কারাবন্দি অবস্থায় ‘স্লো পয়জনিং’ এবং যথাযথ চিকিৎসা না দেওয়ায় তাঁর শরীর একের পর এক জটিলতায় ভেঙে পড়ে। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতাসহ আরও বহু সমস্যায় তিনি আক্রান্ত হন। ধীরে ধীরে তাঁর চলাফেরার ক্ষমতা কমতে থাকে। স্বাস্থ্য এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে প্রায়ই তাঁকে হঠাৎ করে হাসপাতালে নিতে হয়।
সর্বশেষ ২৩ নভেম্বর ২০২৫ রাতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর হার্ট ও ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে; তিনি এখন জীবনমৃত্যুর এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছেন।
প্রিয় মা এমন ভয়াবহ অসুস্থ অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও লন্ডনে অবস্থানরত তাঁর বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না। পরিবার ও দলীয় শীর্ষ সূত্র বলছে, ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রবল চাপ থাকা সত্ত্বেও সম্ভাব্য নিরাপত্তাঝুঁকি, আন্তর্জাতিক নানা সমীকরণ এবং দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা তাঁর ফেরার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২৯ নভেম্বর ২০২৫ সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া বার্তায় তারেক রহমান মনঃকষ্টের সঙ্গে লিখেছেন, ‘এমন সংকটকালে মায়ের স্নেহ-স্পর্শ পাওয়ার আকুলতা যে কোনো সন্তানের মতো আমারও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার নানা জটিলতায় এটি আমার একক সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। সংবেদনশীল হওয়ায় বিস্তারিত ব্যাখ্যারও সুযোগ নেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে এলেই দেশে ফেরার আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হবে- এ আশা আমাদের পরিবারের।’
এ সময় তিনি দেশবাসীর কাছে মায়ের সুস্থতার জন্য আন্তরিক দোয়া চেয়ে জিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই কঠিন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে কটূক্তি ও সমালোচনার বন্যা বইয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আর কিছু সোশ্যাল মিডিয়া কর্মী। তাঁদের একজন জামায়াতপন্থি আইনজীবী শিশির মনির। যিনি আগামী নির্বাচনে জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি ফেসবুকে তির্যকভাবে লেখেন, ‘আমি যদি তরেক রহমানের জায়গায় থাকতাম; কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে অনেক আগেই মায়ের কাছে চলে আসতাম।’ কথাটি শুনে মনে হয়, মায়ের চেয়ে মাসির দরদই যেন বেশি!
দেশবাসী জানেন, জিয়া পরিবার একান্নবর্তী, স্নেহময় একটি পরিবার। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শাহাদাতবরণের পর বেগম খালেদা জিয়া নিজের দুই সন্তান, পুত্রবধূ এবং নাতনিদের একত্রে নিয়ে সংসার চালিয়েছেন। কখনো তাঁদের মধ্যে কলহ, অশান্তি বা বৈরিতার খবর জানা যায়নি। তাঁরা একে অপরের জন্য ছিলেন অন্তঃপ্রাণ।
তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো- দুই ভাই ছিলেন একে অপরের ছায়াসঙ্গী; একই সঙ্গে স্কুল, খেলাধুলা, হজ, ভ্রমণ- সবই করেছেন। দুজনেই মাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন, আর মা দুই পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনিদের ভালোবাসতেন নিজের সমস্ত সত্তা দিয়ে।
২০০৭ সালের ৭ মার্চ ভোরে এক এগারোর অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেনা-সমর্থিত শাসকগোষ্ঠী কোনো মামলা বা ওয়ারেন্ট ছাড়াই তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে। রিমান্ডে বর্বর নির্যাতনে তাঁর মেরুদণ্ডের ৬ এবং ৭ নম্বর হাড় ভেঙে যায়, স্কন্ধদেশের হাড় ফেটে যায়, হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। তিনি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তবু তিনি নিজের কষ্ট ভুলে বারবার কারাগারে বন্দি মায়ের খোঁজ চেয়েছেন; লিখিত আবেদন করেছেন তাঁকে একনজর দেখতে।
এই পরিবারের ওপর আরেকবার আঘাত আসে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রিয় ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর আকস্মিক মৃত্যু। খবরটি শুনে তারেক রহমান পাথর হয়ে গিয়েছিলেন; কিছু বলতেই পারেননি। তারপর শুরু হয় তাঁর শোক, বুকভাঙা কান্না- যে কান্নার প্রতিধ্বনি আজও তাঁর নীরবতায় লুকিয়ে আছে। যে মানুষের হৃদয় এত সংবেদনশীল, এত মমতায় ভরা, তিনি কি তাঁর মাকে দেখতে না আসতে চাওয়ার মানুষ?
তারেক রহমানকে দেশে ফিরতে যেন না দেওয়া হয়, সেজন্য একটি পার্শ্ববর্তী দেশের তৎপরতা এখনো সক্রিয়। দেশের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তাঁকে ঘিরে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ইন্দিরা, রাজীব, বেনজির, গান্ধী থেকে শুরু করে শহীদ জিয়াউর রহমান পর্যন্ত বহু হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস তাঁর নিরাপত্তাঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির এক সদস্য স্পষ্টই বলেছেন, ‘তারেক রহমানের নিরাপত্তা শুধু দেশের বিষয় নয়; আন্তর্জাতিক মাত্রাতেও জড়িয়ে আছে। একমুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।’ তাই বুলেটপ্রুফ গাড়ি, অস্ত্র লাইসেন্স, গুলশানে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও এখনো সবকিছু নিশ্চিন্ত নয়।
অন্যদিকে তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে আইএলআর স্ট্যাটাসে আছেন, দেশে ফিরতে হলে ট্রাভেল পাসসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা অতিক্রম করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে, এটাও অনিশ্চিত।
এসব বাস্তবতা অগ্রাহ্য করেই জামায়াতের আইনজীবীর তির্যক মন্তব্য, কেন? কারণ তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর রাজধানীর কাওলার সিভিল অ্যাভিয়েশন মাঠে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম উল্লেখ না করে বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘তার মা তো অসুস্থ। আপনারা অনশন করেন। তাহলে ছেলে কেন মাকে দেখতে আসে না। এটা কেমন ছেলে, সেটা আমার প্রশ্ন? মা তো অসুস্থ, মরে মরে, সে নাকি যখনতখন মরে যাবে...! হ্যাঁ, বয়সও হয়েছে, অসুস্থ তো বটে। মাকে দেখতে আসে না কেন? আমি তো বলব, মাকে দেখতে আসুক।’ তাঁর কথার অন্তরালে লুকিয়ে ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, তারেক রহমান দেশে এলে তাঁকে ঘিরে নতুন ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতে তাঁকে হত্যা করা। উদ্দেশ্য ছিল বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করা।
আজ একই সুরে মহলবিশেষ সেই পুরোনো ষড়যন্ত্রই পুনরাবৃত্তি করছে। তারা কি চায়, তারেক রহমানও তাঁর বাবার মতো শহীদ হোক? প্রতিদ্বন্দ্বী সরলেই কি তাদের রাজনীতি সহজ হবে?
কৃতজ্ঞতাবোধ থাকলে তারা এ কথা ভাবতে পারত না। যখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ জিয়ার স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হলো, তখন তারা কোথায় ছিল? যখন তাঁকে জেলে নেওয়া হলো, যখন তারেক রহমানকে পঙ্গুদশায় পৌঁছে দেশ ছাড়া করা হলো, তারা কোথায় ছিল? যখন বালুর ট্রাক দিয়ে তাঁকে অবরুদ্ধ রাখা হলো, তারা কোথায় লুকিয়ে ছিল? আজ শুধু সমালোচনার জন্যই তারা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
বিএনপি ১৬ বছরের দুর্দিনে জামায়াতকে আশ্রয় দিয়েছে। না দিলে শেখ হাসিনা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতেন। জামায়াত কোনো বড় আন্দোলন করতে পারেনি, মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প মিছিলেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। আর ঠিক সেই সময়েই তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি বছরের পর বছর রাজপথ প্রস্তুত করে রেখেছে, ফলে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ফের গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে।
কিন্তু এখন আবার বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে পুঁজি করে নানা পক্ষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ৩ ডিসেম্বর বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অসুস্থতা তথা স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।’ এটা নির্বাচন পেছানোর অযাচিত প্রস্তাব, যা সরাসরি দেশের স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলে। ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ স্টার বাংলায় ‘দেশে-বিদেশি বিনিয়োগ ছয় বছরের সর্বনিম্ন’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। আইএমএফ জানিয়েছে, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত ঋণের পরবর্তী কিস্তি দেওয়া হবে না। এই পরিস্থিতিতে দেশের জন্য গণতান্ত্রিক সরকার গঠন অত্যন্ত জরুরি।
বিএনপি কি এসব ষড়যন্ত্র চুপচাপ দেখে যাবে? কখনোই না।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ‘যখন নিশ্চিত হব সব ঠিক আছে তখনই তারেক রহমানকে দেশে নিয়ে আসব।’
তারেক রহমান অবশ্যই দেশে ফিরবেন; তবে গোপনে নয়, বীরের বেশে, বিজয়ীর ভঙ্গিতে। যেদিন তিনি ফিরবেন, সেদিন এই দেশের আকাশবাতাসে ধ্বনিত হবে, ‘তুমি স্বাধীনতা রাখবে অমলিন, আমাদের তারেক রহমান।’
হাসবে গরিব-দুঃখী মানুষ, আনন্দে ভরে উঠবে রাজপথ আর কাঁদবে দেশিবিদেশি সব ষড়যন্ত্রকারী।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, আহ্বায়ক, আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল