বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। হাসপাতালে শয্যাশায়ী। দেশবাসীর চোখ সেদিকে নিবদ্ধ। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে রাতদিন জটলা নেতা-কর্মীদের। নেত্রীর দেখা পাবে না জেনেও সারা দেশ থেকে লোকজন ছুটে আসছে হাসপাতালের সামনে। অনেকে দোয়ার আয়োজন করছে। কেউ করছে কান্না। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ শুধু একজন রাজনীতিবিদই নন তিনি দেশবাসীর ভরসাস্থল। ৪২ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে তাঁকে। স্বামীর মৃত্যুর পর আটপৌরে গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে পা বাড়ান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপির হাল ধরতে। ১৯৮২ সালে বিএনপি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে এরশাদ প্রথমেই কোপ হানেন বিএনপির প্রতি। সেই দুঃসময়ে মির্জা গোলাম হাফিজ আর ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদারের মতো শত শত চৌকশ ও মেধাবী রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতির পথচলায় ছিলেন নিত্যসঙ্গী। স্বৈরাচার এরশাদ তখন মরিয়া বেগম খালেদা জিয়ার পথচলা রুদ্ধ করতে। প্রথমে বেগম খালেদা জিয়াকে টোপ দেন উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার। সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলে তাঁর ওপর নেমে আসে জেলজুলুম। কোনো কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি ।
এরশাদবিরোধী পাঁচ দফার আন্দোলনকে এক দফায় নিয়ে আসেন তিনি। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের প্রহসনের নির্বাচন অংশ না নিয়ে দেশবাসীর কাছে আপসহীন নেত্রীর অভিধায় অভিহিত হন। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ, ১২ জুনের সপ্তম, ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঁচটি আসনে নির্বাচন করে সবগুলোতে জয়লাভ করেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠাতা পেয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে বেগম খালেদা জিয়া দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১২ জুনের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১১৬টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় হয়। খালেদা জিয়া নির্বাচিত হন বিরোধীদলীয় নেত্রী। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১৯৬টি আসনে জেতে। বেগম খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য একটা পক্ষ উঠেপড়ে লাগে। একসময় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। বিএনপির ওপর নেমে আসে অত্যাচারের স্টিম রোলার। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে জেলখানায় আটকে তাঁদের ওপর চলে নানারকম নির্যাতন। ওই সরকার দায়মুক্তির জন্য আঁতাত করে ২০০৮ সালে প্রহসনের নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসায়। ওই নির্বাচনেও তিনটি আসন থেকে নির্বাচন করে সবগুলোতে জয় পান খালেদা জিয়া। স্বল্পসংখ্যক আসন নিয়েও গণতন্ত্র রক্ষায় বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর আদালতের ফরমায়েশি রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা হয়। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল দেশবাসী।
২০১৮ সাল থেকে খালেদা জিয়াকে আটকে রাখা হয় জেলখানা ও গৃহবন্দি অবস্থায়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এতিমের টাকা তিনি নাকি খেয়ে ফেলেছেন। অথচ ব্যাংকের টাকা ব্যাংকেই আছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে মুক্তি মেলে খালেদা জিয়ার। দেশের আপামর জনতা মজলুম নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দেশের অভিভাবকের সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৮৬ সালে কবি মুশাররফ করিম খালেদা জিয়াকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন, যার সূচনাংশ- ‘না রাজা না মন্ত্রী না কোনো যুদ্ধবাজ সেনাপতি/ আমার সমস্ত উচ্চারণে উচ্চকিত/ বেগম খালেদা জিয়ার পবিত্র নাম/ উড়ন্ত কবুতরের শুভ্র ডানা ছাড়া তাঁর চোখে দেখিনি নীলনকশা/ শস্যের সবুজ দাবি মতলবের ছককাটা কাগজে/ নেই তাঁর সই/ রোদের সোনায় ঢাকা রাজপথ ফেলে/ সুঠাম মহলে বসেনি সে গোপন আঁতাতে/ মাথার ওপর একখণ্ড মেগমুক্ত সুনীল আকাশ আর/ পায়ের পাতার নিচে সার্বভৌম কালো মাটি/ সামনে বাংলাদেশের স্বাধীন মানচিত্রে/ সূর্য অঙ্কিত পতাকা/ চারপাশে আবালবৃদ্ধবনিতা অর্থাৎ জনগণ/ এই নিয়ে তাঁর স্বপ্ন, এই নিয়ে তাঁর আশা, ভালোবাসা/ বেগম খালেদা জিয়া মানে আকাশের সমান সাহস/ তাঁর দুই হাত যেন ঈশা খাঁর তরবারি/ নতজানু ক্রীতদাসের মতো লিখতে শিখেনি দাসখত/ ... নোয়াতে পারেনি তাঁর গর্বিত মাথা/ ...’ সেই খালেদা জিয়া আজ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। দেশের আপামর জনতার দোয়া তাঁর সঙ্গে। আল্লাহ খালেদা জিয়াকে সুস্থ করে দিন।
লেখক : সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রতিদিন