মানুষের জীবন অসংখ্য ছোটবড় প্রয়োজনের সমষ্টি। কিছু দৃশ্যমান, কিছু অদৃশ্য; কিছু বস্তুগত, কিছু মানসিক ও নৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতিদিনের সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবন গড়ার উপাদান। তবু খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদার দৌড়ে আমরা প্রায়ই অদৃশ্য প্রয়োজনগুলো ভুলে যাই; যা মন, বুদ্ধি, মূল্যবোধ ও সম্পর্ক জীবিত রাখে। এগুলো উপেক্ষা করলে বাইরের সাফল্য থাকলেও ভিতরে মানুষ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আজ ১০ ডিসেম্বর, বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণের পর থেকে দিনটি পালিত হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য : ‘মানবাধিকার, আমাদের প্রতিদিনের অপরিহার্য বিষয়।’ মানবাধিকার কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়; এটি প্রতিদিনের জীবনের অপরিহার্য অংশ। সম্মান, সমতা, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ন্যায়- এগুলোই মানবিক সমাজের ভিত্তি।
বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির গতি এত দ্রুত যে কয়েক বছরের মধ্যে একসময়ের দক্ষতা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। অনলাইন কর্মসংস্থান থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবই মানুষের জীবনযাপন, শেখার ধরন, কাজের কাঠামো বদলে দিয়েছে। এ সময়ে প্রয়োজন শুধু ডিগ্রি নয়; প্রয়োজন কার্যকর দক্ষতা- সমস্যা সমাধান, তথ্য বিশ্লেষণ, যৌক্তিক চিন্তা, প্রযুক্তি ব্যবহার, আর্থিক সচেতনতা, দলগত দক্ষতা ও ভাষাজ্ঞান। প্রতিদিন ছোট করে হলেও কিছু শেখা একজন মানুষকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আধুনিক জীবনের চাপ মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করছে। যানজট, কর্মক্ষেত্রের প্রতিযোগিতা, অনিশ্চিত কর্মসংস্থান ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত প্রভাবের ফলে অনেকেই মানসিক ক্লান্তি ও অস্থিরতায় ভুগছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেকে সময় দেওয়া, পরিবার ও প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো, বই পড়া, সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত থাকা এবং নিয়মিত প্রার্থনা ও কৃতজ্ঞতা চর্চা মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক। পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রামও জরুরি। তাদের পরামর্শ, দৈনন্দিন জীবনে সচেতনভাবে বিরতি নিয়ে নিজেকে শোনা ও জীবনের গতি নিয়ন্ত্রণে আনা মানসিক সমস্যার প্রতিরোধে কার্যকর। নিজেকে অবহেলা করলে ধীরে ধীরে আনন্দ, উদ্যম, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সবই দুর্বল হয়ে পড়ে। সময়ব্যবস্থাপনা জীবনের অন্যতম অদৃশ্য শক্তি। প্রতিটি মানুষের দিনই ২৪ ঘণ্টা, কিন্তু ব্যবহারের পার্থক্যই জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ধারণ করে। ডিজিটাল যুগে মনোযোগ সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। অনেকেই সারা দিন ব্যস্ত থেকেও উৎপাদনশীল হতে পারেন না। তাই দিনের শুরুতে ৫-১০ মিনিটের পরিকল্পনা, কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও দিনের শেষে ছোট সেলিব্রেশন সবই জীবনকে সুশৃঙ্খল করে। পরিকল্পনাহীন জীবন পাহাড়বিহীন নদীর মতো দিক হারায়, গতি কমে, লক্ষ্য হারিয়ে যায়। মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী। সহমর্মিতা, সদাচরণ, সহযোগিতা এসব মানুষের মৌলিক সামাজিক প্রয়োজন। একজন মানুষ যখন অন্যের পাশে দাঁড়ায়, তখন সে নিজের ভিতরেও শক্তি, শান্তি ও তৃপ্তি খুঁজে পায়। হাসিমুখে কথা বলা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, কারও কষ্ট মন দিয়ে শোনা, নীরব সহায়তা এসব ছোট আচরণ সমাজকে মানবিক করে তোলে। প্রযুক্তির অগ্রগতির যুগেও মানবিকতা ছাড়া উন্নয়ন কখনোই পূর্ণতা পায় না।
প্রযুক্তি শুধু ব্যবহারের বিষয় নয়, এটি বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ব্যবহারের ব্যাপার। ডিজিটাল নিরাপত্তা, ই-সেবা, অনলাইন ব্যাংকিং, ডেটা ব্যবস্থাপনা, ক্লাউড সিস্টেম, ইমেইল এটিকেট, সাইবার নিরাপত্তাজ্ঞান এসব হলো আজকের যুগের প্রয়োজনীয় দক্ষতা। কারণ প্রযুক্তি সুবিধা দিচ্ছে ঠিকই, পাশাপাশি প্রতারণা, ভুল তথ্য, জালিয়াতি, হ্যাকিংয়ের ঝুঁকিও বাড়ছে। তাই প্রতিদিন কিছু নতুন শেখা মানুষকে প্রযুক্তিতে দক্ষ ও নিরাপদ করে। দৈনন্দিন প্রয়োজন শুধু জীবনধারণের উপকরণ নয়; এটি একটি জীবনদর্শন। শেখা, সচেতনতা, মানবিকতা, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস, প্রযুক্তিজ্ঞান, সময়ব্যবস্থাপনা, আর্থিক শৃঙ্খলা, পরিবেশরক্ষা এসব ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতির ভিত্তি। প্রতিদিনের ছোট সিদ্ধান্তগুলোই ভবিষ্যতের বড় ফল তৈরি করে। প্রতিদিনই নতুন সুযোগ নিজেকে উন্নত করার, ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং একটি মানবিক সমাজ গড়ার। মানবিকতাই মানুষের প্রকৃত শক্তি। ধনসম্পদ, পদবি, সাফল্য সবই মূল্যবান; তবে সততা, সহমর্মিতা ও মানবিকতার মূল্য তার চেয়েও অনেক বেশি।
প্রতিদিনের ছোট ছোট মানবিক আচরণ সমাজকে এগিয়ে নেয়। প্রয়োজন শুধু বেঁচে থাকার নয়, মানুষ হয়ে ওঠার। আর সেই পথ শুরু হয় সবচেয়ে সহজ জায়গা থেকে নিজের প্রয়োজনগুলো সঠিকভাবে বোঝা এবং প্রতিদিন তা পূরণের পথে সচেতনভাবে অগ্রসর হওয়া। মানবাধিকার রক্ষিত হোক সবার প্রতিদিনের প্রতি কল্যাণ পদক্ষেপে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট