মানবজীবনের প্রকৃত সফলতা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাই একজন মুমিনের প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কাজই হওয়া উচিত সেই মহান সন্তুষ্টির সন্ধানে নিবেদিত। কিন্তু কোন কোন কাজ আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়—এ প্রশ্নটি যুগে যুগে প্রত্যেক ঈমানদারের হৃদয়ে অনুরণিত হয়েছে। যার মাধ্যমে একজন বান্দা সহজ, সুন্দর ও শুদ্ধভাবে তার রবের নৈকট্য অর্জন করতে পারে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার আলোক পথে অগ্রসর হতে পারে।
১. নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা
নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও উত্তম আমল। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম : কোন আমল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়? তিনি জবাব দিলেন—নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম : তারপর কোনটি? তিনি বললেন, তারপর মাতা-পিতার সঙ্গে সদয় আচরণ করা। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, তারপর আল্লাহর পথে জিহাদ করা।
’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০৯৫)
২. পিতামাতার প্রতি সদয় হওয়া
আল্লাহ তাআলা মাতা-পিতার প্রতি সদয়তার নির্দেশকে তাঁর একত্ববাদের (তাওহিদ) পরপরই উল্লেখ করেছেন। তিনি মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতাকে নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। আল্লাহ বলেন : ‘আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না; আর মাতা-পিতার সঙ্গে সদয় হও।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৬)
তিনি আরো বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন যে তোমরা তাঁর বাইরে কারো ইবাদত করবে না এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদয় থাকবে।
তাদের একজন বা উভয়েই যদি বার্ধক্যে তোমার কাছে পৌঁছে যায়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বোলো না, তাদের ধমক দিয়ো না, বরং তাদের সঙ্গে সম্মান ও কোমলভাবে কথা বোলো।’
(সুরা : ইসরা/বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৩)
৩. সৎকর্মে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা
ছোট আমল হলেও যদি তা নিয়মিতভাবে করা হয়, তবে তার মূল্য আল্লাহর কাছে অনেক বেশি। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো সেই আমল, যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা অল্প হয়।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭৮৩)
তাই একজন মুসলমানের জন্য সৎকর্মে স্থির থাকা এবং তা নিয়মিতভাবে করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. কোরআন তিলাওয়াত করা
কোরআন তিলাওয়াত করা, মুখস্থ করা, গভীরভাবে এর অর্থ ও মর্মার্থ নিয়ে চিন্তা করা এবং জীবনে বাস্তবায়ন করা—এসবের মাধ্যমে একজন মুসলিম দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর কাছে উচ্চ মর্যাদা লাভ করে।
আনাস ইবন মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মানুষদের মধ্যে কিছু বিশেষ মানুষ আছে, যারা আল্লাহর নিকটবর্তী।’ সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা?’ তিনি বলেন, ‘তারা হলো কোরআনের লোকেরা—আল্লাহর লোক এবং আল্লাহর বিশেষ মনোনীত বান্দা।’
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭৯)
৫. রাস্তা থেকে ক্ষতিকারক জিনিস অপসারণ করা
সমাজ ও মানুষের উপকারে আসে এমন কাজ করা ইসলামে অত্যন্ত মহৎ আমল। তার মধ্যে অন্যতম হলো রাস্তা থেকে ক্ষতিকারক বা বিরক্তিকর জিনিস দূর করা। এটি জান্নাতে প্রবেশের কারণ হিসেবেও বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আমি এক ব্যক্তিকে জান্নাতে আনন্দ করতে দেখলাম, কারণ সে রাস্তা থেকে একটি কাঁটাযুক্ত ডাল বা গাছ অপসারণ করেছিল, যা মানুষের ক্ষতি করছিল।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯১৪)
৬. আল্লাহর পথে দাওয়াত
আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান করা, ইসলামের বার্তা প্রচার করা এবং ছড়িয়ে দেওয়া—আল্লাহর কাছে অত্যন্ত সম্মানজনক ও প্রিয় আমলগুলোর একটি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর কথায় তার চেয়ে উত্তম কে হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকর্ম করে এবং ঘোষণা করে ‘নিশ্চয়ই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা : ফুসসিলাত, আয়াত : ৩৩)
৭. বিপদগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাকে অবকাশ দেওয়া
যে ব্যক্তি আর্থিক কষ্টে আছে, যে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম, তার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা ইসলামে অত্যন্ত মহৎ গুণ। নবী করিম (সা.) বিপদগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাকে সময় দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবন আবি কাতাদাহ (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি—‘যে ব্যক্তি চায় যে আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিনের বিপদ ও কষ্ট থেকে রক্ষা করুন, সে যেন কোনো বিপদগ্রস্ত ঋণগ্রহীতা ব্যক্তিকে অবকাশ দেয় অথবা তার ঋণ মাফ করে দেয়।’
(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২৫৫৯)
৮. মানুষের উপকার করা
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন যে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় তারা, যারা মানুষের সবচেয়ে বেশি উপকার করে। আর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো কোনো মুসলিমকে আনন্দ দেওয়া, তার কষ্ট দূর করা, তার ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া অথবা ক্ষুধার সময় তাকে আহার করানো।’
(তবারানি, হাদিস : ৬০২৬)
৯. আল্লাহর স্মরণ (জিকির) করা
আল্লাহর স্মরণ পাপ মোচনের পথ, হৃদয়ের প্রশান্তি, তাকওয়া বৃদ্ধি এবং মর্যাদা উন্নীত করার অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যারা পুরুষ, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং যারা নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে—আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহান প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।’
(সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৫)
মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর কাছে কোন আমলটি সবচেয়ে প্রিয়? তিনি বলেন, ‘এভাবে মৃত্যুবরণ করা যে তোমার জিহ্বা আল্লাহর স্মরণে সিক্ত থাকবে।’
(সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ৫১৬)
১০. রাতে ইবাদত করা ও নফল রোজা রাখা
রাতের বেলা ইবাদত করা এবং নফল রোজা রাখা—উভয়ই আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় আমল। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাকে বললেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় রোজা হলো দাউদ (আ.)-এর রোজা; তিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং পরদিন রোজা ভাঙতেন। আর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সালাত হলো দাউদ (আ.)-এর নামাজ; তিনি রাতের অর্ধেক অংশ ঘুমাতেন, এরপর এক-তৃতীয়াংশ সময় তাহাজ্জুদ পড়তেন এবং শেষ এক-ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১৩১) এ দুটি মহৎ অভ্যাস—রোজা ও রাতের ইবাদত বান্দাকে তার প্রভুর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত করে।
বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল