বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতীয় সংসদের নির্বাচন শুধু একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নয়; এটি জাতির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দু। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনও দেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যার ফলাফল নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনর্গঠনের গতিপথ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার ভিত্তি। দেড় দশকে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, ক্ষমতাসীন সরকারের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা এবং বিরোধী শক্তির সংকীর্ণ উপস্থিতি প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা কাঙ্ক্ষিত অবস্থান থেকে পিছিয়ে দিয়েছিল। এই বাস্তবতায় সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য জনগণের আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকাই এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
সেনাবাহিনী জাতির নৈতিক ও মানসিক ভরকেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে জন্ম নেওয়া এই বাহিনী প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রশাসনিক দুর্বলতা বা রাজনৈতিক সংকট—সব ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীলতার অসাধারণ নজির স্থাপন করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি জাতীয় সংকটে তারা দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে। ফলে জনগণের মনে সেনাবাহিনী নিরাপত্তা, ভরসা ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
২০২৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে সেনাবাহিনীর ভূমিকা শুধু নিরাপত্তা প্রদানে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি জনগণের গণতান্ত্রিক আস্থা পুনর্গঠনের ভিত্তি হতে পারে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারে যদিও জনগণের সমর্থন রয়েছে, তার পরও দলীয় রাজনৈতিক কাঠামো বা নির্বাচন পরিচালনায় তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সীমিত। বিপরীতে পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন আগের সরকারের রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশ্নবিদ্ধ জবাবদিহি ও জন-আস্থা হারানোয় এককভাবে এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয়। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার বিতাড়িত হলেও তাদের অনুগত নেতাকর্মীরা রয়েছে দেশব্যাপী।
তারা অংশগ্রহণ করতে না পারার কারণে নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করবে, সেটা ধারণা করা যায়। এ অবস্থায় নিরপেক্ষতা, পেশাদারি ও শৃঙ্খলার সমন্বয়ে সেনাবাহিনীই একমাত্র শক্তি, যারা নির্বাচনী নিরাপত্তা তদারকিতে নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
অতীতে সেনা কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু এসব সমালোচনা সামরিক প্রতিষ্ঠানের সমষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে নয়; বরং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের অধীনে কর্মরত কিছু ব্যক্তির ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ, পদের প্রতি লোভ বা রাজনৈতিক চাপের প্রতিফলন। সেনাবাহিনী কখনোই সমষ্টিগতভাবে ক্ষমতার লোভে পরিচালিত হয়নি। তাদের সাংগঠনিক নীতি, শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, স্বচ্ছ পেশাদারি সর্বদা জনগণের কল্যাণে নিবেদিত।
অতএব, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার দায় পুরো বাহিনীর ওপর চাপানো অন্যায় ও ভিত্তিহীন; এগুলো ছিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট ব্যক্তিগত বিচ্যুতির উদাহরণ।
রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষা, সন্ত্রাস দমন, সীমান্তে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান প্রতিরোধ, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে উদ্ধার ও পুনর্বাসন—সব ক্ষেত্রেই সেনাবাহিনী সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্যতম শক্তি। তাদের গুরুত্ব, পেশাদারি ও মানবিকতা বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। এসব আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, যা ‘গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে কর্তৃত্ববাদের যুগ’ হিসেবে পরিচিত। সে সময় সেনাবাহিনী বহু ক্ষেত্রেই সীমিত ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়।
সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক আস্থা পুনরুদ্ধারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনী যদি সফলভাবে নির্বাচন নিরাপদ, সহিংসতামুক্ত ও স্বচ্ছ করতে পারে, তাহলে এর সুফল হবে বহুমাত্রিক। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান আরো সুদৃঢ় হবে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, জনগণের আস্থা ফিরবে, রাজনৈতিক বিভাজন কমে আসবে; এবং সবচেয়ে বড় অর্জন হবে গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ।
সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে ভয়ের নয়, বরং আস্থার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য তাদের আচরণ হতে হবে পেশাদার, মানবিক ও জনবান্ধব; বিশেষত নারী, সংখ্যালঘু ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি সংবেদনশীলতা থাকবে। পাশাপাশি ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধে তথ্য প্রতিক্রিয়া সেল গঠন, নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে রিয়াল-টাইম সমন্বয় এবং আধুনিক গোয়েন্দা কাঠামোও জরুরি।
২০২৬ সালের নির্বাচনের সাফল্য নির্ভর করবে সেনাবাহিনী কতটা নিরপেক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে পারে, তার ওপর। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে সংবিধানসম্মত, পেশাদার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত। সেনাবাহিনী যদি এবার নিরপেক্ষ ও দৃঢ়ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, তাহলে এর সুফল হবে বহুমাত্রিক। প্রথমত, গণতন্ত্রকে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই করার জন্য যে ‘ভয়মুক্ত ভোটাধিকার’ সবচেয়ে মৌলিক ভিত্তি, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন মানে জনগণের মতামত আদতে রাষ্ট্রক্ষমতা নির্ধারণ করবে, যা গণতন্ত্রের প্রাণ।
দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ নতুন করে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও উন্নয়ন সহযোগীরা বহুদিন ধরে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জোর দিচ্ছিল; সেনাবাহিনীর দক্ষ ও মানবিক নেতৃত্বে নির্বাচন সফল হলে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা বাড়বে; বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগ, বাণিজ্য সুবিধা ও শান্তি রক্ষা মিশনে বিস্তৃত সুযোগ তৈরি হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সব সময়ই আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অংশীদারদের প্রধান চাহিদা; সেনাবাহিনীর ভূমিকা সেই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।
তৃতীয়ত, দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিবেশেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা ব্যবসার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল; একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বিনিয়োগকারীদের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে, আর্থিক বাজারে স্থিতিশীলতা তৈরি করবে, সরকারি নীতি প্রণয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সুযোগ সৃষ্টি করবে। নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর পেশাদার নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা শুধু প্রতিদিনের সহিংসতা কমাবে না; বরং দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলবে—যেখানে মতবিরোধ থাকবে, কিন্তু সংঘাত থাকবে না।
চতুর্থত, একটি সফল নির্বাচন সেনাবাহিনীর নিজেদের মর্যাদাও অক্ষুণ্ন রাখবে। অতীতের কিছু বিতর্ক ও রাজনৈতিক চাপের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর একটি অংশ অনিচ্ছাকৃতভাবে সমালোচিত হয়েছিল। এখন তাদের সামনে রয়েছে সেই সমালোচনা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে জনগণের আস্থা পুনর্গঠনের সুযোগ, যা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অমূল্য সম্পদ। সেনাবাহিনী যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে তারা শুধু জাতির আস্থা অর্জন করবে না, বরং প্রমাণ করবে যে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় তারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান।
সব শেষে বলা যায়, বাংলাদেশের ২০২৬ সালের নির্বাচন সেনাবাহিনীর জন্য এক ঐতিহাসিক সুযোগ—তা নিজেদের নৈতিক অবস্থান, পেশাদারি দক্ষতা, মানবিক আচরণ ও সাংবিধানিক আনুগত্যকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার সময়। পাশাপাশি বহুবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, কিন্তু টিকে আছে মানুষের সংগ্রাম, আশাবাদ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের কারণে। আজ আবার সেই একই মুহূর্ত এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে জনগণের আশা, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল ভূমিকার ওপর নির্ভর করছে। তারা যদি পেশাদারি, নিরপেক্ষতা ও দেশপ্রেমের সুষম মেলবন্ধনে দায়িত্ব পালন করে, তাহলে ২০২৬ সালের নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং একটি জাতীয় পুনর্জাগরণের প্রতীক হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ প্রমাণ করবে, সংকটময় সময়ে জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি তার জনগণ ও সেনাবাহিনীর পারস্পরিক আস্থা, যা গণতন্ত্র অটুট রাখে এবং রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যায় একটি সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল ও মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
Mizan12bd@yahoo.com