সম্প্রতি সরকার ‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’ জারি করেছে দেশের ব্যাংকিং খাতের অতি ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ব্যাংকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ টাকা, যা আগে ছিল মাত্র এক লাখ টাকা। এখন দেশের কোনো ব্যাংক অবসায়ন হলে আমানতকারীরা তাৎক্ষণিক দুই লাখ টাকা ফেরত পাবেন। নতুন এই অধ্যাদেশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—(১) এর মাধ্যমে আগের ব্যাংক আমানত বীমা আইন ২০০০ বাতিল ঘোষণা; (২) আমানত সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পৃথক বিভাগ গঠন; (৩) এই বিভাগ হবে স্বতন্ত্র, অর্থাৎ এর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ থাকবে না; (৪) ব্যাংক ও আর্থিক কম্পানির জন্য দুটি পৃথক সুরক্ষা তহবিল গঠন; (৫) এই নিশ্চয়তা শুধু সাধারণ আমানতকারীদের জন্য প্রযোজ্য, অর্থাৎ সরকারি এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানের আমানত এর আওতায় পড়বে না; (৬) ঝুঁকিভিত্তিক প্রিমিয়াম ব্যবস্থার অধীনে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা হবে; (৭) নতুন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এককালীন প্রিমিয়াম প্রদানের বাধ্যবাধকতা; (৮) আমানত নিশ্চয়তা তহবিল একটি ট্রাস্ট হিসেবে গণ্য হবে এবং (৯) বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এই আমানত সুরক্ষা তহবিলের ট্রাস্টি বোর্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং এ রকম উদ্যোগ অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সময়ে মাত্র দুই লাখ টাকার আমানতের নিশ্চয়তা দিয়ে কী এমন লাভ হবে? টাকার মানের যে মাত্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে, তাতে দুই লাখ কেন, ১০ লাখ টাকারও প্রকৃত মূল্য একেবারেই কম। এর চেয়েও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ পর্যন্ত ব্যাংক আমানতের নিশ্চয়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে কোনো কারণে ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে সাধারণ আমানতকারীরা যেন পথে না বসেন এবং তাঁদের আমানতের কিছু অংশ এমনভাবে ফেরত পাবেন, যা দিয়ে তাঁরা টিকে থাকতে পারবেন। কিন্তু মাত্র দুই লাখা টাকা পর্যন্ত আমানতের নিশ্চয়তা দিয়ে এই উদ্দেশ্য কোনোভাবেই সফল হবে না। অথচ এই নিশ্চয়তা বিধানের কাজটি হবে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, যা এককথায় সামান্য কাজে বিশাল আয়োজন।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, এই কাজ বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে রাখা ঠিক কি না? নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণ আমানতকারীদের অর্থের নিশ্চয়তা বিধান করবে। কিন্তু তারা নিজেরা কাজটা করবে না, বরং অন্যদের দিয়ে করাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এ ধরনের কাজ নিয়ে নিজেরা ব্যস্ত থাকে, তাহলে তারা দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং এ খাতের মানোন্নয়নে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মতো কাজ করার সময় পাবে কিভাবে?
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আমানতকারীর অর্থের নিশ্চয়তা প্রদানের কাজটি করা সম্ভব নয় এবং করার সুযোগ থাকাও ঠিক না। এ জন্য প্রয়োজন পৃথক এবং স্বতন্ত্র ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করা। আমেরিকার মতো দেশেও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে, যা এখন বর্ধিত করে মাঝারি আমানতকারী পর্যন্ত নেওয়ার চেষ্টা চলছে। সেখানেও এই কাজ ডিপোজিট ইনস্যুরেন্সের মাধ্যমেই করা হয়। আমেরিকায় আছে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান, ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন, যারা ব্যাংক আমানতের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। শুধু আমেরিকা কেন, কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই আছে ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন। এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশেও এই ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন চালু আছে। যেমন—ভিয়েতনামে আছে ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স অব ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ায় আছে পারবাধামান ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় আছে ইন্দোনেশিয়া ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন।
আমাদের দেশেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি আমানতকারীদের অর্থের নিশ্চয়তা দেওয়া প্রয়োজন এবং এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (বিডিআইসি) প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। আসলে বাংলাদেশে যখন বেসরকারি খাতে ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছিল, ঠিক তখনই এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা উচিত ছিল। আমানতকারীদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের নিরাপত্তা বিধান না করেই ব্যাংকিং খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটানো হয়েছে। বিগত পাঁচ দশকেও এই বিষয়টি নিয়ে কোনো পক্ষই ভাবেনি। এমনকি যে আইএমএফ সরকারকে সকাল-বিকাল উপদেশ দেয় এবং নানা শর্তের বেড়াজালে সরকারকে আটকে ফেলে, তারাও এ রকম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনো রকম সুপারিশ করেছে বলে আমরা শুনিনি। যা হোক, দেরিতে হলেও এখন এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। তবে সবার আগে এ রকম এক-দুই লাখ টাকার আমানতের নিশ্চয়তার কথা বাদ দিয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কমপক্ষে দুই বা তিন কোটি টাকার আমানতের নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বিবেচনা করা প্রয়োজন।
বিডিআইসি গতানুগতিক ধারার ইনস্যুরেন্স কম্পানি থেকে ভিন্ন এবং একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান হবে, যাদের কাজ হবে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ পর্যন্ত নিশ্চয়তা প্রদান করা। সেই সঙ্গে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া বা বন্ধ হয়ে গেলে তার নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে সম্পদ সংগ্রহের কাজটিও করবে এই প্রতিষ্ঠান। যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করবে, তারাই হবে এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য। বিডিআইসির পরিচালনা পর্ষদ এমনভাবে গঠন করা হবে, যার প্রধান বা চেয়ারম্যান হবেন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং উপপ্রধান বা ভাইস চেয়ারম্যান হবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নির্বাহী কর্মকর্তা। অন্যরা সদস্য ব্যাংকগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত বা মনোনীত হতে পারেন।
এই প্রতিষ্ঠান যদি তিন কোটি টাকা পর্যন্ত আমানতের নিশ্চয়তা প্রদান করে, সে ক্ষেত্রে এই মর্মে শর্ত থাকবে যে তিন কোটি পর্যন্ত আমানত, অর্থাৎ নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত আমানত নির্দিষ্ট কিছু ঝুঁকিমুক্ত বা কম ঝুঁকির খাত ছাড়া অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগ বা ঋণ প্রদান করা যাবে না। যেমন—নগদ জামানতের বিপরীতে, সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠান, আধাসরকারি, স্বায়ত্তসাশিত প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রজেক্ট, সুপ্রতিষ্ঠিত বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যাদের ঝুঁকির মাত্রা একেবারেই নেই, সে রকম প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো খাতে ঋণ প্রদান করা যাবে না।
প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিশ্চয়তা দেওয়া আমানতের ওপর নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম প্রদান করবে। তবে ছোট ও মাঝারি ব্যাংকের চেয়ে বৃহৎ ব্যাংকের প্রিমিয়ামের পরিমাণটা একটু বেশি হবে। তা ছাড়া নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত আমানতের ওপর সুদের হার তুলনামূলক কম হবে। কেননা এ ধরনের আমানতের ঝুঁকির পরিমাণ কম বিধায় রিস্ক প্রিমিয়াম থাকবে না। সমগ্র প্রক্রিয়াটি প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে, যাতে নিয়মিত ডিপোজিট প্রিমিয়াম প্রদান, নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত আমানত নির্ধারিত কম ঝুঁকির খাত ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ না থাকে। এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় এবং যথেষ্ট জটিলও বটে। তাই বিস্তারিত তুলে ধরতে গেলে একটি বই লিখতে হবে। তার পরও অন্য কোনো পরিসরে কিছুটা বিস্তৃত পরিসরে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আমানতকারীদের দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থের নিশ্চয়তা প্রদান করে ‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’ জারি করলেও এর মাধ্যমে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। তাই এটিকে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে রেখে বাংলাদেশ ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সরকার যেহেতু দেশের ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের রিফরম আনার চেষ্টা করছে, তাই এখনই উপযুক্ত সময় ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করার। দেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এবং সেই সঙ্গে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি আমানতকারীদের রক্ষা করতে হলে এই ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনের কোনো বিকল্প নেই। উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার স্বার্থে ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন প্রয়োজন।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা