অবশেষে সব শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনের চূড়ান্ত ধাপে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। রবিবার নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রূপরেখা চূড়ান্ত করেছে। আজ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে কমিশন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। এরপর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নির্বাচনের চূড়ান্ত তফসিল ঘোষণা করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এ আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে দেশজুড়ে শুরু হবে নির্বাচনি উৎসব।
সবকিছু ঠিক থাকলে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়ে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনের রবিবারের বৈঠকের মধ্য দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার পূর্ণ হতে চলেছে। চলতি বছরের আগস্টে, জুলাই বিপ্লবের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। রবিবার নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ৮ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যে কোনো দিন তফসিল ঘোষণা করা হবে। ভোট হবে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে যে কোনো দিন।
শেষ পর্যন্ত দেশে নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে নানানরকম আলোচনা এবং অনিশ্চয়তা ছিল। নির্বাচন কমিশনের রবিবারের বৈঠকের মধ্য দিয়ে সেই অনিশ্চয়তার কিছুটা অবসান হলো। এখন শুরু হলো আসল পরীক্ষা। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটা নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষার চেয়েও বড় পরীক্ষা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। এটি সম্ভবত তাঁর দায়িত্বের মেয়াদকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শেষ পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় যদি তিনি উত্তীর্ণ হন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।
নির্বাচন কমিশন যদিও বলেছে তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত কিন্তু কমিশন যতই জোর দিয়ে নির্বাচনের কথা বলুক না কেন, সাধারণ মানুষের মনে এখনো নির্বাচন হওয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এ সন্দেহ দূর করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করাই এখন প্রধান উপদেষ্টার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
দেশের মানুষ নির্বাচন চায়। সাধারণ মানুষ মনে করে দেশে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে তা উত্তরণের একমাত্র পথ হলো নির্বাচন। একটি গণতান্ত্রিক সরকার চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। দেড় বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। নির্বাচিত সরকার এসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করবে এটাই জনগণ বিশ্বাস করে। দেশজুড়ে প্রতিদিন নানা রকম দাবিদাওয়া নিয়ে চলছে আন্দোলন এবং অসহিষ্ণুতা। একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হলে এসব সমস্যার যৌক্তিক সমাধান হবে বলে জনগণ বিশ্বাস করে। গোটা দেশে একটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো গণতন্ত্র। প্রধান উপদেষ্টা নিজেও এটা বিশ্বাস করেন। এজন্যই তিনি এখন নির্বাচনকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। বারবার নির্বাচনসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করছেন, পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব নতুন করে সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন বক্তব্যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে আগামী নির্বাচন হবে এযাবৎকালের সেরা নির্বাচন। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্তর্র্বর্তী সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। কোনো বিশেষ দলের প্রতি এ সরকারের পক্ষপাত নেই। নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে আন্তরিক। এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন সংযত ও দায়িত্বশীল ভূমিকায় রয়েছে। তার পরও নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন কঠিন হয়ে পড়বে। তফসিল ঘোষণার আগেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ঘটছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও চলছে সন্ত্রাস। পুলিশ বাহিনী এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সক্রিয় নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেটুকু সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে তা সশস্ত্র বাহিনীর কল্যাণে। তফসিল ঘোষণার পর যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে নিরাপত্তার কারণে মানুষ ভোট কেন্দ্রে যেতে ভয় পাবে। মনে রাখতে হবে, ভোটার উপস্থিতি এবার সফল নির্বাচনের প্রধান চাবিকাঠি। নির্বাচনে যদি ভোটার উপস্থিতি বেশি হয় তাহলে নিশ্চয়ই এ নির্বাচন একটি গ্রহণযোগ্য এবং ভালো নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু যদি ভোটার উপস্থিতি কম হয়, তাহলে এ নির্বাচন নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে অনেক প্রশ্ন উঠবে। মনে রাখতে হবে, শুধু বাংলাদেশের জনগণ নয়, গোটা বিশ্ব আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে। নির্বাচন ভালো না হলে নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বেশি সমালোচনা হবে প্রধান উপদেষ্টার। কারণ তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত এবং সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি নোবেলজয়ী।
গত দেড় বছর গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ মসৃণ করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা। রাজনৈতিক দলগুলো আগস্ট অভ্যুত্থানের পর নানা মত ও পথে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নির্বাচন এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর অনৈক্য চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। জামায়াত ও এনসিপি প্রথমে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের পক্ষে ছিল না। তারা আগে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চেয়েছিল। এ নিয়ে জামায়াতের নেতৃত্বে আট দল আন্দোলনও শুরু করে। আট দলের দাবি ছিল প্রথমে গণভোট করতে হবে। অন্যদিকে বিএনপিও জুলাই সনদের কিছু বিষয় নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। বিশেষ করে গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে তাদের আপত্তি আছে। এসব মতপার্থক্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেন প্রধান উপদেষ্টা। নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তিনি রাজনৈতিক বিরোধ সামাল দিয়ে সব দলকে নির্বাচনের পথে নিয়ে এসেছেন। এটা সহজ ছিল না। অনেকেই মনে করেন, একমাত্র ড. ইউনূসের কারণেই সব দলকে নির্বাচনে রাজি করা সম্ভব হয়েছে। তিনি সব দলের সব দাবি শোনেননি আবার সব দাবি নাকচও করেননি। যে দলের যে দাবি ন্যায্য এবং যৌক্তিক মনে হয়েছে, ততটুকুই তিনি গ্রহণ করেছেন। একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি যে কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান করতে পারেন তার অনন্য উদাহরণ এটি। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের সংগঠন এনসিপিকে নির্বাচনে আনাটা প্রধান উপদেষ্টার একটি বিরাট সাফল্য। এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। দলীয় নিবন্ধন এবং প্রতীক নিয়ে দলটির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা অভিভাবকসুলভ মনোভাব দেখিয়ে তাদের মান ভাঙাতে সক্ষম হন। সব দলকে নির্বাচনের মহাসড়কে নিয়ে আসার কাজটি কত কঠিন ছিল তা খালি চোখে বোঝা সম্ভব নয়।
এখন সব দল নির্বাচনমুখী। জনগণ ভোট দিতে উন্মুখ। এ রকম একটি নির্বাচনি আবহ সৃষ্টির জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে অবশ্যই একটি ধন্যবাদ দিতে হবে।
কিন্তু সামনে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ। যে কোনো মূল্যে আগামী নির্বাচন উৎসবমুখর করতেই হবে। ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে যেতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। একমাত্র ভোটার উপস্থিতিই পারে আগামী নির্বাচনকে একটি গ্রহণযোগ্য ও ভালো নির্বাচনের মর্যাদা দিতে। আর সেজন্য দরকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। নাগরিকদের জন্য নিরাপদ ও ভীতিহীন ভোট কেন্দ্র। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার। সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার।
প্রধান উপদেষ্টার জন্য এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটাই তাঁর এ সময়ের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় তাঁকে অবশ্যই বিজয়ী হতে হবে। তবে আমাদেরও মনে রাখতে হবে যে এজন্য সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে সংযত আচরণ করতে হবে। প্রশাসনকে কাজ করতে হবে নিরপেক্ষতার সঙ্গে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে হবে নিষ্ঠার সঙ্গে। আশার কথা, প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনী যেন নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে সেজন্য প্রধান উপদেষ্টা বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে লটারির মাধ্যমে এসপি ও ওসি পদায়নের মাধ্যমে পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক পদায়নের ক্ষেত্রেও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের পক্ষপাত আর বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, জনগণকে উদ্যোগী হতে হবে। ভোটারদের মনে রাখতে হবে, এ ভোট তাদের অধিকার। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে দৃঢ় এবং সাহসী ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। দেশটা আমাদের সবার। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা পারি এ দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে। এমন একটি নির্বাচন করতে যা বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।