দেশীয় গ্যাস থেকে সরে গিয়ে বাংলাদেশ ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) উপর। যা চাপ বাড়িয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের মজুতের ওপর। বাংলাদেশে এলএনজি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে নরওয়ের বিনিয়োগ স্থানান্তর নিয়ে এক গবেষণায় এ কথা বলা হয়।
বুধবার রাজধানীতে আয়োজিত এক সংলাপের শুরুতে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ। একশনএইড বাংলাদেশ ও বিজনেস স্টান্ডার্ড যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে। আর গবেষণাটি যৌথভাবে করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ও একশনএইড বাংলাদেশ।
এতে বলা হয়, এলএনজি আমদানির কারণে বিদেশি অর্থদাতাদের ওপর নির্ভরতা আরও গভীর করেছে। বলতে গেলে- সামগ্রিকভাবে আমদানি করা এলএনজি হলো একটি আর্থিক ফাঁদ।
আরও বলা হয়, নরডিক দেশগুলো বিশ্বব্যাপী জলবায়ু নেতা হিসেবে পরিচিত। অথচ তাদের অর্থায়ন অনিচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশকে ব্যয়বহুল জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে মারাত্মক অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে এলএনজি আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। ওই সময় থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এলএনজি আমদানি করতে খরচ হয়েছে মোট ১৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এই আমদানি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এলএনজির বিশ্ববাজার অস্থির থাকে, মূল্য ওঠানামা করে। এতে অর্থনীতি ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়া ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়ার পেছনে (ক্যাপাসিটি চার্জ) খরচ হয়েছে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসচালিত। গ্যাসের অভাবে বসিয়ে রেখে উৎপাদন না করেও কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয়েছে বছরের পর বছর। এসব খরচের কারণে সামাজিক খাত ও অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে বরাদ্দ সরিয়ে নিতে হয়।
খুলনায় নির্মিত ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদাহরণ তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে নির্মিত এ কেন্দ্রটি গ্যাসের অভাবে বসে আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় প্রকল্পটি আর্থিক ঝুঁকি তৈরি করেছে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সময়ে খোলাবাজার থেকে এলএনজি কিনতে খরচ হয়েছে ১১ বিলিয়ন ডলার। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে সাড়ে ছয় গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করা যেত। এলএনজি খাতে প্রতি এক ডলার বিনিয়োগ করলে আট ডলার লোকসান হয়। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ১ ডলার বিনিয়োগ করে ৯ ডলার লাভ পাওয়া যায়। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে এলএনজির মতো আর্থিক ঝুঁকি নেই। প্রকল্প চালুর পর জ্বালানির খরচ শূন্য। কর্মসংস্থান হয় এলএনজি খাতের চেয়ে তিন গুণ। জলবায়ুর ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্যাসভিত্তিক জ্বালানি অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে মহেশখালীর মতো এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। হাজার হাজার পরিবারকে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য স্থানচ্যুত করা হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ঐতিহ্যবাহী জীবিকা—যেমন পূর্বপুরুষের লবণ চাষ, চিংড়ি চাষ এবং নষ্ট হয়েছে উর্বর জমি।
গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান। এতে বলা হয়, সৌর ও বায়ু শক্তিতে বিনিয়োগ বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমায়, স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি করে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে নরওয়ের বিনিয়োগ স্থানান্তর করা হলে এলএনজিনির্ভরতার আর্থিক ফাঁদ থেকে মুক্তি মিলবে। তাই নরডিক দেশগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, শতভাগ সৌরবিদ্যুৎ বাংলাদেশে সম্ভব নয়। আবার এলএনজি ছাড়া গ্যাস সরবরাহ হবে না। আরও অনেক বছর প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি করতে হবে। তাই বাস্তবিক অর্থে জ্বালানি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে হবে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, অগ্রাধিকার ঠিক করে এগোতে হবে। সবশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬৫ শতাংশ জ্বালানি আসে আমদানি থেকে। আমদানি থেকে ধীরে ধীরে বের হতে না পারলে একসময় আমদানি করাও কঠিন হয়ে যাবে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একশনএইড বাংলাদেশের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ। এতে আরও বক্তব্য দেন নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা নাজমুল হক, ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) বাংলাদেশের প্রধান জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম প্রমুখ।
সূত্র : প্রথম আলো।