১৯৭১ সালের ১ মে, সেদিন ছিল শনিবার। সকাল ১০টার দিকে শহরতলির আউট সিগন্যাল হয়ে ভাড়াউড়া চা-বাগানের দক্ষিণ দিকে প্রবেশ করে ৫-৬ জন পাক সেনা। তাদের সঙ্গে ছিল এলাকার দফাদার (গ্রাম পুলিশ)। তখন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বন্ধ ছিল চা-বাগানের কার্যক্রম।
পাক সেনারা বাগানের পশ্চিম দিকের একটি স্থানে জড়ো করে পুরুষ চা শ্রমিকদের। সবাইকে লাইনে দাঁড় করানো হয়। শ্রমিকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পাকহানাদার বাহিনীর ১২টি এলএমজি একসঙ্গে গর্জে উঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা চা শ্রমিকদের ওপর।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া বধ্যভূমির সামনে দাঁড়িয়ে সেদিনের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা বলেন ওই বধ্যভূমিতে শহীদ মঙ্গু হাজরার ছেলে ভাড়াউড়া চা-বাগানের বাসিন্দা ভানু হাজরা। মঙ্গু হাজরা ছাড়াও পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন হুসেনিয়া হাজরা, ফাগু হাজরা, হিংরাজ হাজরা, কৃষ্ণ হাজরা, চিনিলাল হাজরা, শরজুয়া হাজরা, টিমা হাজরা, শানিচড়া হাজরা, মহারাজ হাজরা, নুনু লাল হাজরা, নকুলা হাজরা, রামলাল হাজরা, জগো হাজরা, বিশ্বম্বর হাজরা, হিরচুয়া হাজরা, শিবমুরা হাজরা, জুহিয়া হাজরা, চুন্মি হাজরা, অমৃত হাজরা, বিরবলি হাজরা, রামদেও হাজরা, হরপুয়া হাজরা, জোচনা হাজরা, রাজকুমার মাল, হরিকুমার হাজরা, রামছুরক হাজরা, গুরুয়া হাজরা, ফেরচুয়া গৌড়, রামকৃষ্ণ গৌড়, রামচরণ গৌড়, গবিনা গৌড়, ইন্দ্র ভূঁইয়া, চৈতু ভূইয়া, আগ্না ভূঁইয়া, ডমরুচান্দ তুরিয়া, মাংরা তুরিয়া, ব্রজ নারায়ণ গোয়ালা, হোল্লা গোয়ালা, রামলাল মাল, খুদিরাম হাজরা, ডুকুয়া তেলি, গংগা বারই, জগদেও কাহার, গংগা কুর্মী, সম মাঝি, কালাচান্দ ঘাটুয়ার, সুখনন্দন রিকিয়াসন, বকই রেলী, শিব মুন্ডাসহ ৫৭ জন চা শ্রমিক।
আহত হয়েছিলেন কেদার লাল হাজরা, গোলাপ চান্দ হাজরা, রামদাড়ী হাজরা, জুবায়ের হাজরা, চিনিয়া হাজরা, কর্মা হাজরা, ডিকুয়া হাজরা, কাইলা হাজরা, বাংসিং তুরিয়াসহ অনেকে। মুক্তিযুদ্ধের পর গণহত্যার এ জায়গাটিতে প্রাচীর দিয়ে রাখে বাগান কর্তৃপক্ষ। অযত্ন অবহেলায় এই প্রাচীর একসময় ভেঙে যায়। পরে ১৯৯৬ সালে বাগানের শ্রমিকরা নিজ উদ্যোগে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় এই বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। পাশে লিখে রাখেন শহীদ চা শ্রমিকদের নাম।
ভানু হাজরা বলেন, ’৭১ সালে আমার বয়স ছিল ১৩ বছর।
সেদিনের গুলির শব্দ এখনো আমার কানে বাজে। পাক সেনারা চলে যাওয়ার পর আমিসহ বাগানের আরও অন্যরা ওই ছড়ার পাড়ে গিয়ে দেখি পুরো এলাকা রক্তে লাল। একজনের ওপর আরেকজনের লাশ পড়ে আছে। আমার বাবাও ছিলেন সেই লাশের কাতারে। আমি আর মা-বাবাকে লাশের স্তূপ থেকে টেনে বের করি। তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন। বাড়িতে নিয়ে আসার পর বাবা মারা যান। আজও এই বধ্যভূমির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একাত্তরের সেই রক্তাক্ত স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
শহীদ ফাগু হাজরার ছেলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, চা শ্রমিকদের ওপর পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার এ জায়গাটি এক প্রকার অবহেলিতই বলা চলে। এখানে যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের নাম আমি নিজ উদ্যোগে ফলকে লিখে রেখেছি। সরকারের কাছে আবেদন এই বধ্যভূমির শহীদদের স্মরণে একটি ভাস্কর্য করে দেওয়া হোক।