জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে; কথায় ও কাজে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। ভারসাম্য হারালে বিপর্যয় অনিবার্য। সমাজ ও রাজনীতির বহু ক্ষেত্রে আমরা ভারসাম্য হারিয়েছি অনেক আগেই। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপারসন সর্বজন শ্রদ্ধেয় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হাসপাতালের বিছানায় জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন। তাঁর জীবন নিয়ে গোটা জাতি উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত। এই সময়েও আমাদেরই সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে থাকা কিছু মানুষ কথায় ও চিন্তায় কতটা ভারসাম্যহীন হতে পারে, তার প্রমাণ রেখে যাচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে। এরকম সংকটকালেও কেউ পরিহাস করতে পারে, বাজে মন্তব্য করতে পারে এমনটি চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সমাজের ভিতরেই আছে এমন অনেকে, যারা স্থান, কাল ও পাত্রের প্রভেদ ভুলে যাচ্ছেতাই বলতে ও লিখতে পারেন। তাদের জন্য করুণা হয়। এদের পিতামাতা বা শিক্ষক, গুরুজন কেউ কোনো দিন হয়তো কোনো সুশিক্ষা দেয়নি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমরা ভেবেছিলাম, দুঃসময় পেছনে ফেলে বুঝিবা নতুন সূর্যোদয় হলো! মনে পড়ে; সেই দিনটি ছিল সোমবার; রৌদ্রকরোজ্জ্বল। সোমবার মধ্যাহ্নে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল নৈরাজ্য! যারা রাজপথে ছিলেন তাদের অনেকের সঙ্গে এসে যোগ দিল, এত দিন যারা ছিলেন ঘরের কোণে; তারাও। শুরু হলো লুটপাট, ভাঙচুর। গণভবন থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত জ্বলতে দেখলাম প্রতিহিংসার আগুন। একদল মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল নির্বাক ভাস্কর্যগুলোর ওপর। ধুলায় লুটিয়ে পড়ল বহু ঐতিহ্যের স্মারক। কার সাধ্য তাদের থামায়! দেশে তখন কোনো সরকারও ছিল না। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের; বিশেষ করে মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগই ছিলেন পলায়নপর। আক্রমণের শিকার হলো থানাগুলো। কোমলমতি ছেলেমেয়েদের উসকে দেওয়া হলো তাদেরই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। শিক্ষাগুরুর গলায় ঝোলানো হলো জুতোর মালা। জুতোর মালা পরানো হলো মুক্তিযোদ্ধার গলায়। তিন দিন পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে এলেন প্রধান উপদেষ্টার পদে বৃত হবেন বলে।
শাহজালাল বিমানবন্দরে নেমে তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে কিছু কথা বললেন, যা শুনে শান্তি ও গণতন্ত্রকামী মানুষের মনপ্রাণ ভরে গেল। আকাশি নীল রঙের গ্রামীণ চেকের পাঞ্জাবির ওপর অফ হোয়াইট ওয়াচ কোট পরা আমাদের নতুন কান্ডারি শোনালেন নতুন আশার কথা, শোনালেন শান্তি ও গণতন্ত্রের বাণী। তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ছিল সংযত, শান্ত কিন্তু দৃঢ়, নির্মোহ- প্রতিহিংসার লেশমাত্র ছিল না। প্রতিটি কথা যেন তিনি বলছিলেন নিক্তি মেপে- ভারসাম্যপূর্ণ। এমন নিরাসক্ত কথা বা বক্তৃতা- যাই বলি না কেন; বাংলাদেশের মানুষ বহুদিন শোনেনি। সেই কোটেবল কথামালার জন্য সামাজিক মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা সেদিন প্রশংসায় ভেসেছিলেন।
৮ আগস্ট বিমানবন্দরে নেমে তিনি কী কী বলেছিলেন, এক্ষণে তার খানিকটা মনে করার চেষ্টা করছি। তিনি আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন আমরা কেউ কারও শত্রু নই, একসঙ্গে থাকব। বলেছিলেন, এটা দ্বিতীয় স্বাধীনতা। দ্বিতীয় স্বাধীনতা টার্মটি মনে হয় তিনিই চালু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আইন হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করা যাবে না। তিনি এমনও বলেছিলেন, আমার কথা আপনারা শুনবেন। যদি না শোনেন, তাহলে বলেন, আমি নিজের কাজে ফিরে যাব। ড. ইউনূসের কথা রাজনৈতিক কর্মীরা কতটা শুনেছেন বা শোনেননি, তা ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে। তবে ড. ইউনূস যেহেতু চলে যাননি, সেহেতু আমরা ধরেই নিতে পারি যে তাঁর কথা লোকে শুনেছেন এবং তাতে তিনি তুষ্ট।
কিন্তু ইন্টেরিম সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৫ মাসে দেশে যা কিছু ঘটেছে তাতে সংযম, সহনশীলতা ও ভারসাম্যের অংশভাগ অতি সামান্য। ভারসাম্যের অভাব কেবল সরকারের কাজকর্মে নয়, এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে রাজনীতি ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সংস্কারের নামে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, তাতে পরিস্থিতি হয়েছে আরও জটিল। জটিলতার ভার বহন করাও অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
গত সোমবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে একনেক সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংকালে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে অনেক বড় বড় সংস্কার করছে, যেগুলোর পুরো ইমপ্লিকেশন সবাই এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না। অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সংস্কার কমিটি ছিল। সেসব প্রস্তাব আমরা এগিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার নিজের ধারণা, আমরা হয়তো অনেক বেশি, কিছুটা উচ্চাভিলাষী সংস্কার করে ফেলেছি, যা নির্বাচিত সরকারের পক্ষে হজম করা বা সহ্য করা কঠিন হতে পারে।’ ইন্টিরিমের ভরসাম্যহীন কাজের বিষয়ে এর চেয়ে স্পষ্ট সাক্ষ্য আর কী হতে পারে! সরকারের একজন বর্ষীয়ান ও বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা হয়ে এর চেয়ে খোলাসা করে বলার দরকারও পড়ে না। যা কিছু অপ্রয়োজনীয়, যা কিছু অতিরিক্ত তা-ই ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। এক ডজন সংস্কার কমিশন গঠন থেকে শুরু করে এসব কমিশনের রিপোর্ট এবং শেষে ৬টি কমিশন রেখে বাকিগুলোর কথা চেপে যাওয়া সরকারের ভারসাম্যহীনতারই প্রমাণ বহন করে।
অন্যদিকে একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতার অসার বাণী-বচন শুনে শুনে আমাদের কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম। যে দলের প্রতীকের মধ্যে সামাজিক ন্যায় ও ভারসাম্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে, সেই দলের নেতা-কর্মীদেরও কেউ কেউ প্রকাশ্যে এমন সব কথা বলে চলেছেন, যেগুলোর মধ্যে মিজানের লেশমাত্র নেই। মিজান অর্থ নিক্তি বা পরিমিতি।
বিশ্বপ্রকৃতির শৃঙ্খলার মূলে রয়েছে ভারসাম্য। আল্লাহতায়ালা সুরা আর রাহমানে ইরশাদ করেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র নিজ নিজ কক্ষপথে ঘূর্ণয়মান। তিনি আকাশকে করেছেন সুউচ্চ এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন ভারসাম্য। এই সুরায় আল্লাহ ভারসাম্য রক্ষা করার তাগিদ দিয়েছেন। সেই ভারসাম্যের দাবি যখন লঙ্ঘিত হয় তখন বিপদ ধেয়ে আসে নানা দিক থেকে। সভ্যতার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, নানা সময়ে যত বিপদ-বিপর্যয় হানা দিয়েছে, তার কোনোটিই বিনা কারণে হয়নি। প্রতিটি জটিল পরিস্থিতির মূলে ছিল কোনো না কোনো মহলের বাড়াবাড়ি। পরিমিতির সীমা যখনই লঙ্ঘন করা হয়েছে তখনই উল্টো দিক থেকে বিপদ এসে সভ্যতার টুঁটি চেপে ধরেছে।
ল অব ন্যাচরাল রিটার্নের হাত থেকে সীমালঙ্ঘনকারীদের কেউই কখনই বাঁচতে পারেনি। অ্যাডলফ হিটলার সীমালঙ্ঘন না করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয় এসে পৃথিবীটাকে তচনচ করে দিত না। সীমালঙ্ঘন করেছিলেন হিটলার-মুসোলিনি। কিন্তু তার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল বিশ্বমানবকে।
স্মরণযোগ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) শেষ হয় মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধের পরপরই ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার বিশাল অংশজুড়ে দেখা দেয় এক গভীর মানবিক সংকট, যা কেবল অর্থনৈতিক দুরবস্থাই নয়, বরং মানুষের মৌলিক অস্তিত্ব ও মর্যাদাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল।
বাস্তুচ্যুত মানুষের ঢল ছিল যুদ্ধোত্তর কালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ যুদ্ধের কারণে দেশহারা, গৃহহারা বা উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধবন্দি, বেঁচে ফেরা মানুষ, নাৎসি শাসন থেকে পালানো শরণার্থীসহ বিপন্ন নারী-পুরুষ আশ্রয়ের খুঁজে ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়ার নানা প্রান্তে।
খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব ছিল ভয়াবহ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদন ধ্বংস হয়ে যায়, খাদ্য মজুত ফুরিয়ে যায়, রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে পোল্যান্ড, জার্মানি, জাপান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বহু অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টি মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
শিশু ও নারী ছিল এই সংকটের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ। লাখ লাখ এতিম শিশুর আশ্রয়, শিক্ষা ও মানসিক পুনর্বাসন ছিল এক বিশাল মানবিক দায়িত্ব। বিপন্ন হয়ে পড়েছিল বহু নারীর জীবন।
নৈতিক ও মানসিক ট্রমা যুদ্ধোত্তর মানবিক সংকটের আরেকটি গভীর দিক। গণহত্যা, বোমাবর্ষণ, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভয়াবহতা ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা মানুষের মনে তৈরি করেছিল দীর্ঘস্থায়ী ও গভীর ক্ষত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতিতে যে বিষবৃক্ষটির জন্ম হয়েছিল, সেটা হলো আরব জাহানের নাকের ডগায় ইসরায়েল নামের দেশ। ইসরায়েল নামের অভিশপ্ত রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে অশান্তির আগুনে জ্বলছে মধ্যপ্রাচ্য। এমনই আরও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে দূর অতীত এবং নিকট ইতিহাসের পাতায়।
দৈশিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও এমন বিপর্যয়ের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ১৯৭৫ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের পরিণতির মূলেও তো ছিল পরিমিতিবোধের অভাব! ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর আমাদের সমাজ ও রাজনীতির ভিতরে ভারসাম্যের সংকট অতটা তীব্র হয়ে দেখা দেবে তা ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু সেটাই হয়েছে। আর এই সংকটের জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? এজন্য মিলিতভাবে সবাই হয়তো দায়ী; কম কিংবা বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি দায় বর্তায় ইন্টেরিমের কাঁধে। প্রশাসন যদি ঠিকমতো কাজ করত, যারা আইন হাতে তুলে নিয়েছিল তাদের সরকার কেন প্রথম প্রহরেই থামিয়ে দিতে পারল না! কে সে পথে বাদ সেধেছিল? চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে, লুটপাট ও ভাঙচুরের বিরুদ্ধে শুরুতেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলে সীমালঙ্ঘনকারীরা অতটা বাড় বাড়তে পারত না। কিন্তু সরকার মাসের পর মাস ব্যস্ত থেকেছে কম সংস্কার না বেশি সংস্কার করবে- এই প্রশ্ন নিয়ে। দেশের আইনশৃঙ্খলা ও ইলেকশন নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা ছিল না। মাথা ঘামিয়েছে সংস্কার নিয়ে। অথচ সংস্কারের দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তব্য। অধ্যাদেশ জারি করে কোনো টেকসই সংস্কার যে সম্ভব নয়, তা বুঝবার জন্য খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন হয় না! ইতোমধ্যে এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে ধামাচাপা দিয়ে, জনসাধারণকে নয়ছয় বুঝিয়ে কালক্ষেপণের ফলে সমস্যা কেবল বেড়েছে। কমেনি। একটা থেকে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের টাইম ফ্রেম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় শিগগিরই তফসিল ঘোষণা হবে। তবু নির্বাচন প্রশ্নে অনিশ্চয়তার ঘোর কাটছে না। জামায়াতে ইসলামী ও তার মিত্ররা এখনো বলছে জাতীয় নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ প্রশ্নে গণভোট করতে হবে। অথচ দুয়ারে কড়া নাড়ছে ফেব্রুয়ারির ইলেকশন। এসব জটিলতার কারণ একটাই; পরিমিতির অভাব। হাতে সময় যদিও অল্প, তবু রাশ টেনে ধরা হয়তো অসম্ভব নয়।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জীবন আজ সংকটাপন্ন। জাতি উদ্বিগ্ন। কায়মনোবাক্যে মোনাজাত করি আল্লাহ তাঁকে নেক হায়াত দান করুন। জনগণের নেত্রী ফিরে আসুন জনগণের মাঝে। আমিন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক