বছরটা এখনো শেষ হয়নি। খেলাধুলায় বাংলাদেশের বছরটা কেমন গেল এ নিয়ে তো পর্যালোচনা হবে। ২০২৫ শেষ হতে আর কিছুদিন বাকি থাকলেও এখনই দুজনার নাম জোরেসোরেই আলোচনা হচ্ছে। একজন ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরী আরেকজন হকির আমিরুল ইসলাম। নারী ফুটবলার আফঈদা খন্দকার ও অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের নামও আলোচনায় আসবে। আফঈদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নারী জাতীয় ফুটবল দল প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপ চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছে। অন্যদিকে মুশফিকই বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার ১০০তম টেস্ট খেলেছেন। শুধু তাই নয় শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এ রেকর্ড ভাঙা তো দূরের কথা বাংলাদেশের কেউ স্পর্শ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
হামজা প্রবাসী ফুটবলার হিসেবে চলতি বছরেই বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে প্রথম খেলেছেন। ব্যর্থতায় বৃত্তে বন্দি থাকা বাংলাদেশের ফুটবল অনেকটা গর্তে আটকিয়ে গিয়েছিল। জাতীয় দল ঘিরে বিন্দুমাত্র কারও আগ্রহ ছিল না। মার্চে ভারতের মাটিতে হামজা অভিষেক ম্যাচ খেলার পর ফুটবল ঘিরে নতুন আগ্রহ তৈরি হয় সবার মাঝে। এটা ঠিক ইংল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি এ ফুটবলার খেলার পরও এশিয়ান কাপ চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু হামজার একক ক্যারিশম্যা ও নৈপুণ্য দেখে দেশবাসী মুগ্ধ। নিজে গোল করেছেন, করিয়েছেন, গোল ঠেকিয়েছেন। রক্ষণভাগ, মধ্যভাগ, উইং সব পজিশনেই তিনি ছিলেন অতুলনীয়। এমনকি নিশ্চিত গোল রক্ষা করে অনেকটা গোলরক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ফুটবলে এমন অলরাউন্ডারের কখনো দেখা মেলেনি। হামজা বাংলাদেশের হয়ে মাত্র সাতটি ম্যাচ খেলেছেন। অথচ তিনি অল্প সময়ের মধ্যে যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও বাংলাদেশের কোনো ফুটবলার পাননি। হামজার নাম বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে।
হামজার কীর্তি অবশ্যই স্যালুট করার মতো। কিন্তু হকির আমিরুল ইসলাম জুনিয়র বিশ্বকাপে যা করেছেন তা বাংলাদেশের সেরা। খেলেছেন হকি অথচ খেলোয়াড় হিসেবে যে কীর্তি গড়েছেন তা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কেউ পারেননি। একেক খেলা একেক রকম। কিন্তু ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বলে তো কথা আছে। জুনিয়র বিশ্বকাপ হলেও আমিরুল যে ইতিহাস গড়েছেন তা বিশ্ব হকির সব আসরকে ছাড়িয়ে গেছেন। সারা বিশ্বে হকির কত বিখ্যাত খেলোয়াড় তা হিসেব মেলানো মুশকিল। তারাও এমন কীর্তি গড়তে পারেননি। বাংলাদেশের ২০ বছর বয়সি এ খেলোয়াড় এখন বিশ্ব হকির সবচেয়ে আলোচিত নাম কিংবা দুনিয়া হকির বড় বিজ্ঞাপনই বলা যায়। অনূর্ধ্ব-২১ বিশ্বকাপের আগে আমিরুলকে বাংলাদেশেরই কেউ চিনতেন না। এখন বিশ্বকাপে ছয় ম্যাচ খেলেই তাঁর খ্যাতি দুনিয়া ছাড়িয়ে গেছে।
হকির যে কোনো বিশ্বকাপে এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম অংশগ্রহণ। আর তাতেই আমিরুলের বিস্ফোরণ। শচীন টেন্ডুলকারকে যেমন ভারতীয়রা ক্রিকেটের বিস্ময় বালক বলতেন। সেখানে শুধু বাংলাদেশিরা নয়, বিশ্বই আমিরুলকে বিস্ময় বালক বলতে বাধ্য হচ্ছে। আমিরুল শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব হকির গর্ব। এক সময়ে তো বিশ্ব হকিতে ভারত-পাকিস্তানের দাপট ছিল তুঙ্গে। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, বেলজিয়াম বা আর্জেন্টিনাতে তো হকির অনেক বিশ্ব পরিচিত খেলোয়াড় রয়েছেন। কিন্তু আমিরুল যে কীর্তি গড়েছেন তার ধারে কাছেও কেউ কি গেছেন। যে আমিরুলকে নিয়ে এত আলোচনা ও প্রশংসা তিনি কী এমন করলেন যে, বিশ্ব হকিতে আলোড়ন পড়ে গেছে? আসলে আমিরুল কী করতে বাকি রেখেছেন সেটাই প্রশ্ন হতে পারে। বড়দের বা জুনিয়র বিশ্বকাপে অনেকে অভিষেক আসরে হ্যাটট্রিক করেছেন। তাই বলে কি ছয় ম্যাচে পাঁচ হ্যাটট্রিক! সেই রেকর্ড তো শুধু বাংলাদেশের আমিরুলের। পাঁচ হ্যাটট্রিক ছাড়াও টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ১৮ গোল। সেই সঙ্গে চার ম্যাচে ম্যাচসেরা হওয়া। আবার হ্যাটট্রিকের হ্যাটট্রিক করেছেন অভিষেক বিশ্বকাপে। এত কীর্তি বাদই দিলাম। আন্তর্জাতিক যে কোনো হকির আসরে কোনো খেলোয়াড় কি অভিষেকে পাঁচ হ্যাটট্রিক করেছেন? এ রেকর্ড শুধু বাংলাদেশের আমিরুলেরই। ক্রিকেটে তো সাকিব আল হাসান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হয়েছেন। তিনিও ধারাবাহিক কোনো আন্তর্জাতিক আসরে চমক দেওয়ার মতো কীর্তি গড়তে পারেননি। ক্রিকেট, ফুটবল বা বাংলাদেশের যে খেলার কথা বলি না কেন, আমিরুল তুলনাহীন। বাংলাদেশ যদি কোয়ার্টার ফাইনালে যেত তাহলে নিশ্চিত বলা যায় জুনিয়র বিশ্বকাপে আমিরুলই সেরা খেলোয়াড় হতেন। বিশ্বকাপে সবমিলিয়ে বাংলাদেশ ৩১ গোল করেছে সেখানে কি না আমিরুলই করেছেন ১৮ গোল। ডিফেন্ডার হয়ে এত গোল করার রেকর্ড কোনো বিশ্বকাপে কারও আছে কি?