ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী রাজনৈতিক মত দমনে গুম এবং বন্দুকযুদ্ধের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। তাদের পতনের পর গুম ও বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনা না ঘটলেও সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির অগ্রগতি তেমন হয়নি। এখনো পদে পদে লঙ্ঘন হচ্ছে মানবাধিকার। সারা দেশেই খুনোখুনি, মব ও রাজনৈতিক সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। যা নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। এমনকি দায়িত্ব পালনে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন হরহামেশাই। এমন পরিস্থিতিতে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, মানবাধিকারকে সর্বজনিন করতে হবে। না হলে মানবাধিকারের অস্থিরতা কখনোই কাটবে না।
এদিকে ‘আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভিত্তি হোক মানবাধিকার’ এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এ উপলক্ষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো মানববন্ধন ও আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ৩৮৩টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৪ হাজার ৪৭৬ জন। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ২৪১ জন।
পরিবারে ও স্বামীর সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫৩২ নারী। যাদের ৩১৬ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ৭১টি ঘটনা ঘটেছে। হত্যা করা হয়েছে ১৮ গৃহবধূকে। নির্যাতনের শিকার হওয়া ১৫ গৃহকর্মীর মধ্যে মারা গেছেন তিনজন। ১১ মাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯৬৩ শিশু। এর মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে অর্ধেক শিশু। এ ছাড়া হত্যার শিকার হয়েছে ৩৭৩ জন শিশু। হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৭০ সাংবাদিক। যাদের মধ্যে দুজনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১০৪টি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও বিচারবহির্ভূতভাবে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন চারজন, গ্রেপ্তারের আগে ও পরে শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ৯ জন। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৯৫ জন বন্দির। যাদের ৬৪ জনই বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলেন। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। মব ও গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ১৮৪ জনের। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) পরিসংখ্যান বলছে, গত ১১ মাসে কমপক্ষে ৮৫২টি রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১২৯ জন এবং আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৯৬৬ জন। এ সময়ে পাঁচটি মন্দির, ৩৭টি প্রতিমা ও ৩৮টি বসতবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সংখ্যালঘুদের জমি দখলের চারটি ঘটনা ঘটেছে। ২৩৬টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৮৯ জন এবং আহত হয়েছে ১ হাজার ২০ জন শ্রমিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, মানবাধিকারকে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। এর কারণে তুলনা করা হয় কোন সরকারের আমলে মানবাধিকারের পরিস্থিতি কেমন ছিল। ফলে এক সরকারের সময় যে অপরাধগুলো বেশি ঘটে, অন্য সরকারের সময় সেগুলো কমলেও বেড়ে যায় অন্যগুলো। মানবাধিকারকে সর্বজনিন করতে না পারলে এ অস্থিরতা দূর হবে না। মানবাধিকারকে বিশ্বাসের অংশ হিসেবে প্রচার করা উচিত : বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে ‘মানবাধিকার দিবস ২০২৫’। দিবসটি উপলক্ষে গতকাল এক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মানবাধিকারকে বিশ্বাসের একটি অংশ হিসেবে প্রচার করা উচিত, যাতে প্রতিটি মানুষের জীবনের মূল্য মর্যাদার সাথে এবং কোনো বৈষম্য ছাড়াই প্রতিষ্ঠিত হয়।’ এ বছর ‘মানবাধিকার, আমাদের নিত্যদিনের অপরিহার্য’- প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমরা আমাদের জাতীয় মানবাধিকার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে ও বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে আন্তর্জাতিক অংশীদার এবং জাতিসংঘের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি। বাংলাদেশ মানবাধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘের নয়টি মূল আন্তর্জাতিক চুক্তির সবগুলোতে যোগ দিয়েছে, যার সর্বশেষটি হলো গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসন্স ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স। আমরা একই সঙ্গে নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের ঐচ্ছিক প্রোটোকল এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সব মূল কনভেনশনেও সই করেছি, যা আমাদের শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষায় আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আট বছর পরও মিয়ানমার এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। দ্রুততম সময়ে নিরাপদ প্রত্যাবাসন কার্যকর করার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুদৃষ্টি কামনা করেন। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, গাজাসহ বিশ্বের যে কোনো স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার রয়েছি এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত রেখেছি। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সদস্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সমুন্নত রাখতেও আমরা সক্রিয় অবদান রেখে যাচ্ছি। ড. ইউনূস বলেন, চব্বিশের জুলাইয়ে এ দেশের সর্বস্তরের জনগণ নিপীড়ন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদী শাসনকে পরাজিত করে, নিশ্চিত হয় জনগণের অধিকার ও মর্যাদা। অশান্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ আত্মপ্রকাশ করে। আমরা এখন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে একটি গণতান্ত্রিক, অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, যাতে ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাপূর্ণ সমাজ গঠন এবং আমাদের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করার পথ নির্ধারণ করা যায়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বাংলাদেশ-এর রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার আরও সুদৃঢ় করেছি।