বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)–এর তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি (এফসিটিসি)-এর একাদশ বৈঠক (কপ১১) এবার নানা তর্ক-বিতর্কে জমে ওঠে। বৈঠকে, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো (এলএমআইসিএস) জানায় যে, তামাক নিয়ন্ত্রণের নীতি ঠিক করতে তাদের আরও স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দরকার। সাধারণ ধারাবাহিক বৈঠক হওয়ার বদলে প্লেনারি সেশনটি বিশ্বব্যাপী তামাক–নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর দীর্ঘদিনের গঠনগত দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে আসে।
লাইবেরিয়া এবারের আলোচনায় প্রথমেই জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নীতি নির্ধারণে স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরে। তারা জানায়, তামাক নিয়ন্ত্রণে নেতৃত্ব দেবে সংশ্লিষ্ট দেশের নিজস্ব সরকারই। গিনি-বিসাউ, লেসোথো, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, মঙ্গোলিয়া এবং অ্যান্টিগুয়া ও বারবুডার প্রতিনিধিরা একই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের মতে, বহিরাগত নির্দেশনা নীতি অনেক সময় স্থানীয় অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না।
বৈঠকে বড় দাতব্য প্রতিষ্ঠানের প্রভাব সম্পর্কেও প্রশ্ন ওঠে। বেশ কয়েকটি দেশের বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, কপ১১- এ অংশ নেওয়া বহু এনজিও’র অর্থায়নের উৎস ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রোপিস’এর সাথে যুক্ত। এতে নীতিগত আলোচনায় মতের বৈচিত্র্য কতটা নিশ্চিত হচ্ছে, সে প্রশ্ন ওঠে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো (এলএমআইসিএস)- এর মতে, এ ধরনের কেন্দ্রীভূত অ্যাডভোকেসি, কাঠামো নীতি আলোচনাকে একপাক্ষিক করে তুলতে পারে।
ডব্লিউএইচও এখনও ক্ষতি–হ্রাস (harm reduction) কৌশলকে স্বীকৃতি না দেওয়া নিয়ে এ আলোচনাটি আরও জোরদার হয়। কপ১১ বৈঠকের আগেই ফার্মাকোলজি ও টক্সিকোলজিসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের ৫০- এরও বেশি বিজ্ঞানী বিবৃতি দিয়ে ডব্লিউএইচও-এর অবস্থানের সমালোচনা করেন। সংস্থাটি ধোঁয়াবিহীন পণ্যকে পোড়ানো সিগারেটের সমান ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে, যা গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
নিউজিল্যান্ড জানায়, কঠোর করনীতি এবং ধোঁয়াবিহীন পণ্যের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে তাদের ধূমপায়ীর হার এখন ৬.৮%। জাপানে হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস (এইচটিপি) জনপ্রিয় হওয়ার পর ঐতিহাসিক হারে সিগারেট বিক্রি কমেছে। হাঙ্গেরিও এইচটিপি ব্যবহারের বৃদ্ধির সঙ্গে ধূমপানের হার কমার কথা জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৯টি দেশ এইচটিপির ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের বিরোধিতা করে জানায়, এ ধরনের প্রস্তাব বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন এবং এতে অবৈধ বাণিজ্য আরও বাড়তে পারে।
অন্যদিকে, ডব্লিউএইচওর সুপারিশ মেনে চলা দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে মেক্সিকোর কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে ই–সিগারেট নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ধূমপানের হার ১৫.৪% এবং ভেপিং–এর বড় অবৈধ বাজার অসাধু চক্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ভিয়েতনামকে উচ্চ ধূমপানের হার–সম্পন্ন দেশ হিসেবে আলোচনায় আনা হয়েছে। সেখানে প্রায় ১৫.৬ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, নিকোটিন সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে অনেক ধূমপায়ী এখনো প্রমাণিত চিকিৎসা–সহায়ক পদ্ধতি যেমন নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এনআরটি) নিতে আগ্রহী নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (FDA), যুক্তরাজ্যের এনআইসিই (NICE) এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক অ্যাকশন অন স্মোকিং অ্যান্ড হেলথ (Action on Smoking and Health)- এর বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন বলছে, নিকোটিন আসক্তিজনক হলেও এটি ক্যান্সার বা হৃদ্রোগের মূল কারণ নয়। তাই প্যাচ, গামসহ এনআরটি পণ্যগুলো ধূমপান ছাড়তে পদ্ধতি কার্যকর হিসেবে স্বীকৃত।
কপ১১ বৈঠকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর প্রতিনিধিরা জোর দিয়ে বলেন, কার্যকর তামাক–নিয়ন্ত্রণ নীতি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের বাস্তবতার ওপর- যেখানে বাজেট সীমাবদ্ধতা, জনবল সংকট, আইন-প্রয়োগের সক্ষমতা এবং অন্যান্য জাতীয় অগ্রাধিকারের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের মতে, চাপিয়ে দেওয়া নীতি অনেক সময় জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যকে দুর্বল করে এবং অবৈধ বাজারকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই আলোচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশটি এখন অর্থনৈতিক চাপ, বাড়তি চিকিৎসা ব্যয় এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়া অবৈধ সিগারেট বাজারের মতো বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। বর্তমানে দেশের তামাক–নিয়ন্ত্রণনীতি মূলত বেশি কর আর নানা বিধিনিষেধের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু বাস্তবে এসব ঠিকমতো মানা হয় না বরং অনেক সীমাবদ্ধতা ও অনিয়ম রয়ে গেছে। কপ১১-এর আলোচনায় দেখা গেছে, বিশ্ব এখন এমন নীতির দিকে ঝুঁকছে যা নমনীয়, বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি এবং প্রতিটি দেশের নিজস্ব বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই। তাই বাংলাদেশও চাইলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখার পাশাপাশি ধূমপান ছাড়ার সহায়তা বৃদ্ধি, নিকোটিন সম্পর্কে সঠিক তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে তার নীতিতে এমন ভারসাম্য আনতে পারে।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী
বিডি-প্রতিদিন/সুজন