হিমালয়ের ওপর দিয়ে উড়ার সময় অনেক পাইলট দেখেন এক অদ্ভুত দৃশ্য—একই আকাশে একসাথে তিনটি সূর্য জ্বলছে। সাধারণত ভোরের আলোতে ককপিটে দাঁড়িয়ে থাকা পাইলট আর কো-পাইলটের চোখে প্রথমে মনে হয়, হয়তো এটি কোনো প্রিজমের প্রতিফলন। কিন্তু তা নয়। আসলে তারা দেখছেন প্রকৃতির এক বিরল অপটিক্যাল চমক, যাকে বলা হয় সানডগ বা বৈজ্ঞানিকভাবে পারহেলিয়ন।
সানডগ তখন তৈরি হয় যখন আকাশে খুব পাতলা, স্বচ্ছ সিরোস্ট্রেটাস মেঘ ভেসে থাকে। এই মেঘের ভেতরে থাকে সূক্ষ্ম বরফের কণা, যা ছয়কোণা হেক্সাগোনাল আকারের হয়। সূর্যের আলো এই বরফ-কণার মধ্য দিয়ে ঢোকে এবং প্রিজমের মতো বিচ্ছুরণ ঘটে। এর ফলে সূর্যের দুই পাশে দুটি উজ্জ্বল আলোর বল দেখা দেয়, যা আসল সূর্যের মতোই দীপ্ত হয়ে ওঠে। মাঝখানে থাকে আসল সূর্য, দুই পাশে উজ্জ্বল আলোকে সাধারণত মক-সান বা মিথ্যা সূর্য বলা হয়।
ইতিহাসে মানুষ এই দৃশ্যকে প্রায়শই দেবতার ইঙ্গিত বা আকাশের রহস্য মনে করত। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ভোরের আকাশে দুটি নকল সূর্য লক্ষ্য করেছিলেন। রোমান লেখক প্লিনি দ্য এল্ডারও লিখেছেন, কখনও কখনও আকাশে তিনটি সূর্য দেখা যায়, যা আসল সূর্যের পাশে উপরের বা নিচের দিকে নয়, বরং পূর্ব বা পশ্চিম আকাশে থাকে। মধ্যযুগেও মানুষ এই দৃশ্যকে ভয়ংকর ইঙ্গিত হিসেবে দেখেছিল; জেরুজালেমে ১১০৬ সালে এক ইতিহাসবিদ লিখেছিলেন, সকাল ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত আকাশে তিনটি সূর্য আর উজ্জ্বল হ্যালো দেখা যাচ্ছিল।
হিমালয়ের ওপর দিয়ে উড়ার সময় এই দৃশ্য বেশি দেখা যায়। কারণ উচ্চতা, তীব্র শীতল তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার সমন্বয় মেঘের মধ্য বরফ-কণা তৈরি করে। বিমানের ক্রুজিং উচ্চতা প্রায় ৩০–৪২ হাজার ফুটে থাকে, যা সানডগের জন্য আদর্শ। ভারতের মনসুন এবং পাহাড়ি অঞ্চলের ওরোগ্রাফিক লিফটও বরফ-কণা তৈরিতে সহায়তা করে।
NASA জানিয়েছে, হিমালয়ে সানডগ প্রায় বছরজুড়ে দেখা যায়, বিশেষ করে শীতকাল ও প্রি-মনসুন মৌসুমে।
দৃশ্যটি দেখতে অসাধারণ। আসল সূর্য মাঝখানে, দুই পাশে দুটি উজ্জ্বল আলোর বল। রং সাধারণত লাল, কমলা বা হলুদ। কখনও কখনও রংধুনু আভা দেখা যায়। পাইলটরা এই দৃশ্যকে বিমানের ব্ল্যাকবক্সে সংরক্ষণ করেন, কারণ কখনও এটি দূরের অন্য বিমান বা আলোর উৎস হিসেবে বিভ্রম তৈরি করতে পারে। তবে নিজে কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি করে না।
হিমালয়ের আকাশে তিন সূর্য দেখা মানে কোনো বিপদ নয়। বরং এটি আলো, বরফ এবং আবহাওয়ার নিখুঁত খেলা—প্রকৃতি যখন নিজের হাতে এক অপূর্ব অপটিক্যাল ছবি আঁকে। যারা একবার এই দৃশ্য দেখেছেন, তারা এটিকে জীবনের সেরা দৃশ্যগুলোর একটি বলে মনে করেন।
সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে
বিডি প্রতিদিন/আশিক