কোথাও সাপ। কোথাও জিরাফ। কোথাও কুমির। আছে হাতি। গরু ও মোরগ-মুরগির দেখাও মেলে। রাজহংসী, কবুতর, কাঠঠোকরা, দোয়েল, পেঁচা, মাছরাঙা, কোয়েল, খরগোশ, গিনিপিগ, কচ্ছপ, অজগর, কোবরা, বাদুড়, হাঁস যেন তাকিয়ে আছে। কাচের আলমিরায় সারি সারি রাখা বিভিন্ন পশু-প্রাণীর কঙ্কালগুলো যেন জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। যেন একটি কঙ্কালের হাট। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম জিরাফের কঙ্কালটি রয়েছে এই জাদুঘরে। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু) গড়ে তোলা হয়েছে দেশের প্রথম ও বৃহত্তম সংগ্রহশালার অ্যানাটমি মিউজিয়াম (কঙ্কাল জাদুঘর)। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে এটি যাত্রা করে। সিভাসুর ইউসুফ চৌধুরী ভবনের নিচতলায় তিন হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চশিক্ষা ও মানোন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জাদুঘরটি স্থাপন করা হয়। সিভাসুর অ্যানাটমি ও হিস্টোলজি বিভাগের শিক্ষক ও বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমানের ব্যবস্থাপনা এবং বিভাগের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর উদ্যোগে বিভিন্ন প্রাণীর কঙ্কাল দিয়ে বর্ণিল আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে। সিভাসুর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান বলেন, ‘২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়া অ্যানাটমি মিউজিয়ামটি এখন একটি সমৃদ্ধ কঙ্কাল জাদুঘর। পর্যায়ক্রমে এখানে যুক্ত করা হয়েছে অনেক প্রাণীর কঙ্কাল। সর্বশেষ জিরাফের কঙ্কাল স্থাপনের মাধ্যমে জাদুঘরটি সমৃদ্ধ হয়েছে।’ এর মাধ্যমে দেশের শিক্ষার্থীদের ভেটেরিনারি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে এই পেশার সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে কঙ্কাল জাদুঘরটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। প্রাণিসম্পদ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্যতম একটি বিকশিত খাত।

অ্যানাটমি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘এখানে বিভিন্ন গৃহপালিত এবং বন্যপ্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে রাখার ফলে শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক ক্লাসে হাতেকলমে শিখতে পারছে। প্রাণীদেহের অঙ্গ ও তন্ত্রের অবস্থান, গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং কাজ সম্পর্কে শিক্ষাদান করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।’ সিভাসুর ফ্যাকাল্টি অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আমরা এই মিউজিয়ামে এসে হাতেকলমে কাজ শেখার সুযোগ পেয়েছি। এই শিক্ষাটা পেশাগত জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’ বর্তমানে এই জাদুঘরে বিভিন্ন প্রাণীর প্রায় ৩০০টি কঙ্কাল, ৩০টি স্ট্যাফ (প্রাণীর অস্থি থেকে চামড়া আলাদা করে নতুন অবয়ব সৃষ্টির পর পুনরায় চামড়া দিয়ে মোড়ানো), রাসায়নিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন প্রাণীর প্রায় ৫০০ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ২ হাজার অস্থি, ২০০টি বিভিন্ন প্রাণীর মডেল ও তিন হাজার স্লাইড আছে। অ্যানাটমি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে জিরাফ, হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, কুমিরসহ ৩০০ কঙ্কাল। স্টাফিং করা প্রাণীর মধ্যে আছে, মোরগ,

মুরগি, রাজহংসী, কবুতর, কাঠঠোকরা, দোয়েল, পেঁচা, মাছরাঙা, কোয়েল, খরগোশ, গিনিপিগ, কচ্ছপ, অজগর, কোবরা, বাদুড়, হাঁস। আছে মানবদেহ, মানুষের চোখ, হৃৎপি-, জরায়ু, ফুসফুস, কিডনি, স্তন, কুকুর, বিড়াল, শূকর, গাভি ও মুরগির ডিএনএ, ক্রোমোজোম, ছাগল-শূকর ও খরগোশের ভ্রƒণ। ফরমালিন দিয়ে এসব অঙ্গ সংরক্ষণ করা হয়েছে। মিউজিয়ামের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো প্রবেশপথে বসানো বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা থেকে সংগ্রহ করা জিরাফের কঙ্কাল। ২০১৯ সালে মারা যাওয়া জিরাফটির অস্থি ছয় মাস পর কবর থেকে তুলে বিশেষ ব্যবস্থায় চট্টগ্রামে এনে বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে অ্যানাটমি বিভাগে সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিটি অস্থি প্রায় দেড় বছর ধরে জোড়া দিয়ে জিরাফের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কঙ্কাল আনা থেকে সংরক্ষণ ও জোড়া লাগাতে খরচ হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। পৃথিবীতে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোথাও জিরাফের এমন কঙ্কাল নেই। ধারণা করা হচ্ছে, এটি তৃতীয় বৃহত্তম জিরাফের কঙ্কাল। এ ছাড়া হাতির কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়েছে কক্সবাজারের চকরিয়ার সাফারি পার্ক থেকে। সুউচ্চ উটের কঙ্কাল আনা হয় ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে। বিশাল অজগর সাপটি মৃত অবস্থায় সংগ্রহ করা হয় সীতাকুন্ড ইকোপার্ক থেকে। বড় কুমিরের কঙ্কাল আনা হয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত কুমির প্রজনন কেন্দ্র থেকে। মিউজিয়াম সূত্রে জানা যায়, ১৭৪৮ সালে ফ্রান্সের রওমার অঞ্চলে প্রাকৃতিক ইতিহাসের অ্যানসাইক্লোপিডিয়ার স্টাফিং পদ্ধতিতে পাখি সংরক্ষণের কথা জানা যায়। ফ্রান্স, জার্মানি, ডেনমার্ক ও ইংল্যান্ডে তখন এই

পদ্ধতিতে পশু-পাখি ও জলজপ্রাণী এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা হতো। ১৮৩৭ সালে ভিক্টোরিয়া যুগ শুরু হলে স্টাফিং জনপ্রিয় শিল্পে রূপ নেয়। তখন পশু-পাখির স্টাফিং দিয়ে ঘর সাজানো হতো। ১৮৫১ সালে লন্ডনের হাইড পার্কের প্রদর্শনীতে বেশ কয়েক প্রকার পাখির স্টাফিংও ছিল। সিভাসুতে মৃত প্রাণীর চামড়া ছাড়িয়ে ট্যানারির মতো বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পরিষ্কার করে তুলা, রড ও জিআই তার দিয়ে অবয়ব (স্টাফিং) বহাল রাখা হয়েছে। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তন্ত্রের চিত্র এবং জীববিজ্ঞান ও প্রাণিবিদ্যায় অবদান রাখা বিজ্ঞানীদের পোর্ট্রটে।