যুক্তরাষ্ট্র থেকে হাতকড়া এবং পায়ে শিকল পরানো অবস্থায় ফেরত পাঠানো বাংলাদেশিদের ভাষ্য থেকে বর্বরতার রোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া গেছে। ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশেষ সামরিক ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাঠানো হয় ৩১ বাংলাদেশিকে। তাঁদের ওপর পৈশাচিকতার বিবরণ উঠে এসেছে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ, নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশি নাগরিক ফয়সাল আহমেদ (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকায় ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে)। তিনি বলেন, ‘এখনো আমার হাতে দাগ, কোমরে দাগ, আমার পুরো শরীরে স্পট হয়ে আছে। বাংলাদেশে বিমানবন্দরে নামার আগে ৭৫ ঘণ্টা আমাকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হয়েছিল, এমনকি বাথরুমেও যেতে দেয়নি।’ তিনি জানান, পাঁচ বছর আগে ভিজিট ভিসায় বলিভিয়ায় গিয়ে আর দেশে ফেরেননি তিনি। সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে প্রায় ছয় মাসের চেষ্টায় পেরু, ইকুয়েডর, মেক্সিকো হয়ে বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ঢোকেন যুক্তরাষ্ট্রে। পরিচিতজনদের বাসায় আশ্রয় নিয়ে তখন থেকেই বৈধ হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘ওই সময় পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল। থেকে যাওয়ার প্রক্রিয়াটাও খুব ইজি ছিল। বাইডেনের সময় এটা অনেকেই করেছেন।’ তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে গত পাঁচ বছরে সেখানকার বৈধ কাগজপত্র পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন কিংবা তিনবার ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন করেও কাজ হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, অ্যাটর্নি পরিচয় দিয়ে আইনি সহায়তার নামে সেখানেও বাঙালিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার একটি চক্র তৈরি হয়েছে।
ফয়সাল আহমেদ জানান, বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ছয় মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি। সেখান থেকে তাঁকে বাফেলোর একটি ডিটেনশন সেন্টারে নেওয়া হয়। এরপর জায়গা বদলে তিনিসহ আরও কয়েকজনকে হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে নেওয়া হয় লুইজিয়ানার আরেকটি কারাগারে। তিনি বলেন, ‘ভাই, আর কারও যেন এভাবে কারাগারে না থাকা লাগে। ছয়ডা মাস ছিলাম। যে খাবার খাইতে দিত, মানুষ পশুপাখিকেও এমন খাবার খাওয়ায় না।’
ওই ফ্লাইটে আরেকজন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য বিমানে তুলছে সকাল ৮টায়, কিন্তু হাতে, গলায় ও কোমরে শিকল পরানো ছিল রাত ১২টা থেকেই। এরপর প্রায় ২৭ থেকে ২৮ ঘণ্টা বিমানে ছিলাম। আমাকে বাথরুমেও যেতে দেওয়া হয়নি।’
উল্লেখ্য, ফ্লাইটে যে ৩১ জন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ফিরেছেন তাদের অধিকাংশই নোয়াখালীর বাসিন্দা। এ ছাড়া সিলেট, ফেনী, শরীয়তপুর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলার লোকও রয়েছেন। আরও অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রয়েছেন, যাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন ফেরত আসা কর্মীরা। ফেরত আসাদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন বলেন, ‘হাতে বেড়ি, পায়ে বেড়ি, কোমরে বেড়ি। আমেরিকা থেকে বিমানে তুলছে ৪০ ঘণ্টা পর। গার্বেজের মতো ছুড়ে ফেলে গেছে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে।’ টেলিফোনে কথা হচ্ছিল এ পরিস্থিতির শিকার আরেকজনের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, দুই বছর আগে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বৈধভাবে ব্রাজিল গিয়েছিলেন তাঁর ভাই। নয় মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। এর পর থেকেই ছিলেন কারাগারে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ভাইয়ের জন্য জমি বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করছিলাম, প্রায় ৩৫ লাখ খরচ হইছে, এখন আমগো কী হইব?’
ব্র্যাক মাইগ্রেশন সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত সাত মাসে এভাবে ফেরত পাঠানো হয়েছে আড়াই শর বেশি বাংলাদেশিকে, যারা নানাভাবে দেশটিতে ঢুকে বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই সেখানে থেকে গিয়েছিলেন। মার্কিন আইন অনুযায়ী বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবস্থানকারী অভিবাসীদের আদালতের রায় বা প্রশাসনিক আদেশে দেশে ফেরত পাঠানো যায়। আশ্রয়ের আবেদন ব্যর্থ হলে দেশটির অভিবাসন কর্তৃপক্ষ তাঁদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় একাধিক দফায় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।’ তাঁর মতে নথিপত্রহীন কাউকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ফেরত পাঠানোটা স্বাভাবিক, কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতকড়া, পায়ে শিকল পরিয়ে রাখার ঘটনা অমানবিক। ৫০ থেকে ৬০ ঘণ্টা যতক্ষণ তাঁরা ফ্লাইটে ছিলেন হাতে-গায়ে শিকল পরানো ছিল। এমন পরিস্থিতি আসলে একজন ব্যক্তির মধ্যে ট্রমা হয়ে থাকে, আতঙ্ক হয়ে থাকে। সরকারের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেওয়া। অবৈধভাবে কেউ থাকলে বন্দি করে ফেরত পাঠানো হোক, কিন্তু মানবিক দিকও বিবেচনায় রাখা উচিত।’
ব্র্যাক মাইগ্রেশন সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবশেষ দেশে ফেরত আসা ৩১ জনের মধ্যে অন্তত সাতজন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ছাড়পত্র নিয়ে ব্রাজিল গিয়েছিলেন। এরপর সেখান থেকে মেক্সিকো হয়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। এজন্য একেকজন ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করছেন, কিন্তু ফিরছেন শূন্য হাতে।
শরিফুল হাসান বলেন, ‘যে এজেন্সি তাদের পাঠিয়েছিল এবং যারা এ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ছিল, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। অতীতেও নানান অনিয়মের কারণে মালয়েশিয়া, কাতারসহ বেশ কয়েকটি দেশে শ্রমশক্তি পাঠানোর সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে বাংলাদেশের। এমন প্রেক্ষাপটে আফ্রিকা এবং উত্তর আমেরিকার যেসব দেশে বৈধভাবে কর্মী পাঠানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে, সেসব জায়গায় নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।’