তিনি তখন স্কুলে পড়েন। মেলা বসে কুমিল্লা নগরীর টাউন হল মাঠে। সেই মেলা থেকে খেলার জন্য দুটি মুরগি কিনে আনেন। শখের মুরগি দুটি থেকে তিনি গড়ে তুলেছেন নিরাপদ মাছ মাংস দুধ ও ডিমের স্বর্গরাজ্য। কুমিল্লা সদর উপজেলার ধনুয়াখলা গ্রামে এই রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে। এই তরুণ উদ্যোক্তার নাম মোহাম্মদ জিয়াউল হক লিটু। ২০০০ সালে তিনি এ খামার গড়ে তোলেন। মুরগি দিয়ে শুরু করা খামারে এখন গরু ডাকে, ভেড়া ছুটে বেড়ায়, পুকুরের পানিতে মাছ থইথই করে। বিবিএ সম্পন্ন করা লিটু নিজ হাতে মাছ মুরগির খাবার দেন, গরুর দুধ নিয়ে গ্রাহকের কাছে ছোটেন এবং খামারের গরুর গোবর পরিষ্কার করেন। তবে তার শুরুটা এত সহজ ছিল না। পরিবার, স্বজন, সবার এক কথা- ‘লেখাপড়া করে চাকরি খুঁজবে, তা না করে গরুর ঘাস কাটতে নেমেছে!’ গরুর খামার করায় প্রথমে বিয়েও করতে পারছিলেন না। পাত্রীপক্ষের পরিবারের লোকেরা খামার করা তরুণের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। সেই লিটুর খামারে এখন ২০ জনের বেশি মানুষ কাজ করেন। এই খামারের মাধ্যমে তিনি আমিষের চাহিদা মেটাতে পারছেন, সঙ্গে পরিবারের আয়ও বেড়েছে। নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। তাকে দেখে আশপাশের গ্রামের অনেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, ২০ একরের সমন্বিত খামার। ঢুকতেই চোখে পড়ে শিউলি ফুলের গাছ। কিছু ফুল নিচে পড়ে আছে। মিষ্টি ঘ্রাণ বাতাসের গায়ে। ফুলের গালিচার ওপর দিয়ে হেঁটে প্রতিদিন খামারে প্রবেশ করেন লিটু। তারপর শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। খামারে কর্মচারীরা দুধ সংগ্রহ করছেন। পাশ থেকে আসছে গাড়ল প্রজাতির ভেড়ার ডাক। খামার সংলগ্ন ১২টি পুকুরে মাছ থইথই করছে। খাবার পেয়ে মাছগুলো উচ্ছল।
২০ হাজার মুরগির শেডে গেলে চোখে জুড়িয়ে যায়। মুরগির কক কক ডাকে মুখর চারপাশ। সামনের ট্রেতে ডিমের সারি। ঝুড়িতে ডিম তুলছেন কেউ। কেউ আবার মুরগির খাবারের ট্রেতে পানি ও খাবার দিচ্ছেন। খামারে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস। রয়েছে নানা ফল ও সবজি। পাশের জমি থেকে প্রতি বছর আসে প্রায় ২০০ মণের মতো ধান। মোহাম্মদ জিয়াউল হক লিটু বলেন, ‘১৯৮৮ সালে মেলা থেকে দুটি মুরগি এনে শহরের বাসার ছাদে পালন শুরু করি। পরে সরকারি খামার থেকে ২০টি মুরগি কিনে আনি। সেটা এক সময় ২০০ মুরগিতে পরিণত হয়।’
লেখাপড়া শেষ করে সবাই চাকরির কথা বললেও আমার মন পড়ে থাকে মুরগিতে। ২০০০ সালে গ্রামের বাড়িতে এসে পাঁচ হাজার মুরগি দিয়ে খামার গড়ে তুলি। প্রথমে পরিবার স্বজন থেকে আসে নানা বাধা। বাবা প্রবাসী সামসুল হক। প্রথমে আপত্তি করলেও পরে সফলতা দেখে তিনি সহযোগিতা করেন। তার থেকে পুঁজি নিয়ে খামার বড় করি। খামার করতে পুকুর কাটতে হয়, সেই পুকুরে মাছ ফেলি। পুকুর পাড়ে ঘাস দেখে ভাবলাম এবার গরু কিনি। এভাবে খামার বাড়তে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চাকরির পেছনে না ঘুরে তরুণদের এ পেশায় এগিয়ে আসা উচিত। বিশেষ করে নিরাপদ মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমের উৎপাদনে শিক্ষিত তরুণদের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। আয়ের পাশাপাশি এখানে প্রাণীদের সঙ্গে সময় কাটানোর আলাদা আনন্দ রয়েছে। যারা এক সময় নাক সিটকাতেন তারা এখন খামার দেখতে আসেন, ধন্যবাদ জানান। দিন দিন গরু মুরগি মাছের খাবারের দাম বাড়ছে, দাম কমলে আমরা ভালো লাভ পেতাম।’ বাংলাদেশ ডেইরি অ্যাসোসিয়েশন কুমিল্লার সভাপতি ফরহাদ হোসেন ভুইয়া বলেন, ‘খামারের একটা গরুর দাম ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। একটা খামারে কয়েক কোটি টাকার বিনিয়োগ থাকে। বিভিন্ন সময় দুধের দাম কমে যায়। এদিকে গোখাদ্যের দামও বেশি। খাদ্যের দাম কমালে খামারি বাঁচতে পারবে। এ ছাড়া দুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে।’ জেলা প্রাণিসম্পদ প্রশিক্ষণ অফিসার মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে খামারিদের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের এই পেশায় আসাটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। খাবারের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আমরা অবগত রয়েছি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছি।’