বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠন করে অধ্যাদেশ জারির পর থেকে একের পর এক অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে এই সচিবালয়ের। সিনিয়র সচিবের দায়িত্ব অর্পণ, ৪৮৯ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর এবার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যালয়ও উদ্বোধন হচ্ছে। আজ প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক ভবন-৪ এ এই কার্যালয়ের উদ্বোধন করবেন। এরই মধ্যে এই ভবনে ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ লেখা সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, অবকাঠামো, সাংগঠনিক কাঠামো, জনবল নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ শেষ হলেই অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সব ক্ষমতা গেজেট জারির মাধ্যমে এই সচিবালয়ের হাতে আসবে। ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫ এর গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে কার্যকরভাবে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জনের পথ খোলে। পরদিন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকীকে এ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ওইদিনই স্বাক্ষরে গঠন করা হয় ‘পদ সৃজন’ কমিটি। গত ৭ ডিসেম্বর ওই কমিটির প্রথম সভায় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের জন্য ৪৮৯টি পদ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে ১০৭ জন কর্মকর্তা ও ৩৮২ জন সহায়ক কর্মচারীর পদ রয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পর জনবল নিয়োগের পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ চলছে বলেও সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে অধস্তন আদালত, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি এবং সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন বা কারিগরি প্রকল্প চূড়ান্ত নিরীক্ষা ও সুপারিশ করার ‘পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ এই কমিটি গঠন করে দিয়েছেন বলে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় এর সাচিবিক সহায়তা প্রদানকারী কর্মকর্তা (সিভিল জজ) মীর মাশহুর আহমেদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. রেজাউল হককে সভাপতি গঠন করা আট সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি মো. যাবিদ হোসেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের সচিব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অধ্যাদেশ জারির পর থেকেই আমাদের মূল কাজটা শুরু হয়ে গেছে। অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাজেট প্রণয়নসহ বিচার বিভাগের অধিকাংশ ক্ষমতাই সুপ্রিম কোর্টের হাতে চলে এসেছে। এখন অবকাঠামো, জনবল ও আনুষঙ্গিক কাজগুলো শেষ হলেই গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে বাকি বিষয়গুলোও সুপ্রিম কোর্টের হাতে চলে আসবে। তিনি বলেন, কার্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় এখন দৃশ্যমান।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সারা দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হবে বলে জানান। এরপর সুপ্রিম কোর্ট থেকে গত বছরের ২৭ অক্টোবর এ বিষয়ে সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের সঙ্গে ধারণাপত্র ও খসড়া অধ্যাদেশ পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। এরপর বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। সর্বশেষ জাতীয় একমত্য কমিশনের প্রতিবেদনেও সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই তিন খসড়া ও প্রস্তাবকে সমন্বয় করে আইন মন্ত্রণালয় একটি চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করে। গত ২০ নভেম্বর এই চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এর ১০ দিনের মাথায় ৩০ নভেম্বর ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫’ জারি করেন রাষ্ট্রপতি। ওইদিন আইন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বিচারকাজে নিয়োজিত বিচারকদের পদায়ন, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ও ছুটিবিষয়ক সব সিদ্ধান্ত ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় এ সচিবালয়ের হাতে থাকবে। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সচিবালয়ের সচিব প্রশাসনিক প্রধান হবেন।
এ অধ্যাদেশের ৭ ধারা বাদে বাকি সব ধারা অবিলম্বে কার্যকর হবে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন সম্পন্ন এবং এটির কার্যক্রম পূর্ণরূপে চালু হওয়া সাপেক্ষে সরকার সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে এ অধ্যাদেশের ধারা ৭ এর বিধানাবলি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে কার্যকর করবে। অধ্যাদেশের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সংক্রান্ত কাজে রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রয়োজনীয় সব প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবে।
অধ্যাদেশের ৭ ধারায় যা আছে : এ অধ্যাদেশের ৭ ধারায় সার্ভিস প্রশাসনের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে বলা হয়েছে, (১) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সার্ভিস প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হইবে। (২) সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সার্ভিস সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সংক্রান্ত কাজে রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রয়োজনীয় সকল প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করিবে। (৩) সার্ভিস সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সংক্রান্ত কার্যাদি সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিব কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট কমিটির পরামর্শের জন্য উপস্থাপিত হইবে। (৪) উপ-ধারা (৩) এ উল্লিখিত কমিটির সদস্যগণ নির্ধারিত পদ্ধতিতে আপিল বিভাগের বিচারকগণ কর্তৃক মনোনীত হইবেন। (৫) উপ-ধারা (২) এর বিধান সত্ত্বেও আইন ও বিচার বিভাগ ও ইহার কার্যপরিধিতে বর্ণিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এবং অন্য কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের দপ্তরে সার্ভিস সদস্যগণের পদায়ন বা বদলি সংক্রান্ত কার্যাদি এতদুদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বিধিমালা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে সম্পাদিত হইবে।