চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ৫০ বছয় বয়সি গৃহিণী ফারহানা বেগম (ছদ্মনাম) স্ট্রোকে চাপ পড়ে মস্তিষ্কে। বেঁকে যায় মুখ। চিকিৎসার প্রয়োজনে খুলে নেওয়া হয় মাথার খুলির বাম অংশ। কয়েক মাস পর ডিফেক্ট অনেক বড় হয়ে যায়। ফলে তিনি ঘর থেকে বের হতে সংকোচবোধ করতেন। পরে তার মাথার জন্য থ্রি ডি পদ্ধতিতে প্রিন্টেড কাস্টমাইজড ক্র্যানিওপ্লাস্টি (খুলির কিছু অংশ অপসারণের সার্জারি) তৈরি করা হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে খুলিটি মাথায় স্থাপন করা হয়। এরপর স্বাভাবিক হয় তার মুখ। কমে মাথার ব্যথা। শুরু করেন স্বাভাবিক জীবন। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ও স্ট্রোকে মাথার খুলি নষ্ট হওয়ার পর তা প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। জটিল ও ব্যতিক্রম চিকিৎসায় ফিরে পাচ্ছেন নতুন ও স্বাভাবিক জীবন। পুনর্জন্ম হচ্ছে চিকিৎসায়। এটি দেশের চিকিৎসায় অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করে। গৃহিণী ফারহানা বেগম বলেন, স্ট্রোকে আমার মুখের বামপাশটা বেঁকে যায়। এ সময় টানা ছয় মাস ঘর থেকে বের হইনি। পরে চিকিৎসক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেখানে কৃত্রিম খুলি প্রতিস্থাপন করেন। এখন আগের মতোই স্বাভাবিক। ফিরে পাই আত্মবিশ্বাস। এখন আগের মতো ঘর-সংসার সবই সামলাই।
জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এবং পার্কভিউ হাসপাতালে মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মাথার খুলি অপসারণের বিরল ও জটিল চিকিৎসাটি হচ্ছে। শয্যা ও অপারেশন থিয়েটারসহ নানা কারণে চমেক হাসপাতালে জটিল চিকিৎসাটি কম হলেও পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়মিতই এটি হচ্ছে। এ হাপসাতালে ইতোমধ্যে ১০৩টি কৃত্রিম ও মৌলিক খুলি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৪টি অটোলোগাস এবং বাকিগুলো থ্রি-ডি বোন, বোন সিমেন্ট ও টাইটানিয়াম মেশ ব্যবহার করে তৈরিকৃত কৃত্রিম ক্র্যানিওপ্লাস্টি। উন্নত বিশ্বে এমন সার্জারি নিয়মিত হলেও দেশে এখনো ব্যতিক্রম। তবে মস্তিষ্কের সুরক্ষা ও সৌন্দর্য পুনর্গঠনের অত্যন্ত জটিল ও সূক্ষ্ম সার্জারির সংখ্যা এখন বাড়ছে। পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ টি এম রেজাউল করিম বলেন, মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের পর মাথার খুলি অপসারণ- একটি কঠিন বাস্তবতা। জীবন বাঁচাতে এই পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। জীবন রক্ষা থেকে জীবনমান উন্নয়ন, মস্তিষ্কে চাপ কমানো, গুরুতর সংক্রমণ, দুর্ঘটনা, রক্তক্ষরণ বা টিউমারের কারণে অনেক সময় রোগীর মাথার খুলির একটি অংশ অপসারণ করতে হয়। পরবর্তীতে তা প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। জটিল এ চিকিৎসা এখন নিয়মিতই হচ্ছে।
চমেক হাসপাতালের নিউরো-সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ইসমাইল হোসেন বলেন, এটি কেবল অপারেশন নয়, পুনর্জন্ম। প্রতিটি রোগীর ক্র্যানিওপ্লাস্টি আমার কাছে নতুন দায়িত্বের মতোই। প্রতিটি রোগীর খুলির ক্ষত আলাদা। তাই কোন পদ্ধতি ব্যবহার হবে, তা নির্ভর করে রোগীর নিরাপত্তা, বয়স, বাজেট ও ডিফেক্টের ধরন অনুযায়ী। চেষ্টা করি সবচেয়ে উপযোগী সমাধানটি দিতে। তিনি বলেন, ক্র্যানিওপ্লাস্টি শুধু মাথার আকৃতি ফিরিয়ে দেয় না, মানসিক, সামাজিক, নিউরোলজিক অবস্থাও উন্নত করে। কারণ আধুনিক ইমেজিং প্রযুক্তি (সিটিস্ক্যান, থ্রিডি প্রিন্টিং) ব্যবহার করে রোগীর মাথার গঠন অনুযায়ী হুবহু খুলি ডিজাইন করা হয়।
পরে বিশেষ বায়োকম্প্যাটিবল মেটেরিয়াল দিয়ে তৈরি করা হয় খুলি। এটি যা মানবদেহের জন্য নিরাপদ, দীর্ঘস্থায়ী। এই প্রতিস্থাপন শুধু ব্রেনকে সুরক্ষা দেয় না, রোগীর স্বাভাবিক চেহারাও ফিরিয়ে আনে। দেশের নিউরো সার্জারি চিকিৎসায় ক্র্যানিওপ্লাস্টি এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
চিকিৎসকরা বলেন, ক্র্যানিওপ্লাস্টির মূল উদ্দেশ্য হলো- মস্তিষ্ককে পুনরায় সুরক্ষা দেওয়া, মাথার স্বাভাবিক আকৃতি ফিরিয়ে আনা, সিংকিং স্কিন ফ্লেপ সিনড্রম প্রতিরোধ করা, নিউরোলজিক ফাংশন ও কগনিটিভ ক্ষমতা উন্নত করা, রোগীর আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা। চিকিৎসকরা মনে করেন, অনেক রোগীর ক্ষেত্রে স্কাল রিকন্সট্রাকশনের পর হাঁটাচলা, স্মরণশক্তি, কথা বলা- সব কিছুতেই উন্নতি দেখা যায়।
প্রসঙ্গত, ক্র্যানিওপ্লাস্টি হলো- একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি, যা মাথার খুলির ত্রুটি বা বিকৃতি মেরামত করে। এই অস্ত্রোপচারে মাথার খুলির ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি পুনরায় তৈরি করা হয়, যেখানে সাধারণত পূর্বে সরানো খুলির হাড় অথবা কৃত্রিম উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এটি মাথার আঘাত বা বড় ধরনের ক্র্যানিওটমির পরে করা হতে পারে, যা মস্তিষ্ককে সুরক্ষা, কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার এবং শারীরিক সুস্থতা বাড়াতে সাহায্য করে।