যে সংসারে আয় থেকে ব্যয় বেশি, সে সংসার ঋণগ্রস্ত হতে বাধ্য। দেশও সংসারের মতোই। তবে জনসংখ্যা ও আয়তনে বড়- এই যা পার্থক্য। মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, যে দেশ অর্থ, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি যে কোনো একটিতে পিছিয়ে থাকবে, সে দেশ আরেকটি উন্নত দেশের অধীনে থাকতে বাধ্য। বাংলাদেশ ঋণগ্রস্ত হওয়ার পিছনে রয়েছে অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ হলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ পরিশোধ না করা। ব্যাংক যখন বুঝবে ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করবে না, ঋণ গ্রহীতাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কিংবা খুঁজে পাওয়া গেলেও ঋণের টাকা আদায় করা সম্ভব নয়, তখন তাদের ঋণখেলাপি তালিকায় ফেলা হয়।
অর্থাৎ ঋণখেলাপি মানেই অপরাধী হিসেবে বিবেচ্য। একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে শিল্প স্থাপনের নামে মোটা অংকের ঋণ নিয়ে থাকেন। ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাও বিভিন্ন নামে ব্যাংকের টাকা ঋণ নিয়ে শিল্প স্থাপন না করে সেই টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। এস আলম গ্রুপ একটি উদাহরণ। তারা ঋণ বিতরণের আগে (নিজেদের মধ্যে) মর্টগেজ (বন্ধক) দেওয়া সম্পত্তি অত্যধিক মূল্য দেখিয়েছিলেন। এমনও দেখা গেছে, তারা যেসব সম্পত্তি দেখিয়েছেন সেসব সম্পত্তি কাগজে কলমে আছে মাত্র, বাস্তবে নেই।
২০১২ সালে হল মার্ক কেলেঙ্কারি দিয়ে ব্যাংকের টাকা লুটপাট করা শুরু হয়। হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদের ভায়রাভাই ছিলেন সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখার ম্যানেজার। তার সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন। পরে দেখা যায়, মর্টগেজ দেওয়া সম্পত্তির অধিকাংশ কাগজই ভুয়া। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী, ব্যাংক ম্যানেজারসহ মোট ৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কয়েক দিন আগে তানভীর মাহমুদ জেলের মধ্যে মারা যান। তাদের কারাদণ্ড হয়েছে; কিন্তু টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি (সে সময়কার অর্থমন্ত্রী আবুল আল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ৫ হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই না)।
২০২৪ সালের শেষের দিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫ সালে সেই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায়। বর্তমানে ৩৬% টাকা অনাদায়ী। আমাদের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেককে ৪০ হাজার করে টাকা পরিশোধ করতে হবে। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ। এরপর রয়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। বাণিজ্য ঘাটতি হলো রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি হওয়া। আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে সবচেয়ে চীনের সঙ্গে। দেশটি থেকে গত বছর ২ হাজার ৬১ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করা হয়েছে; এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয়েছে ১ হাজার ৯৮৭ কোটি ডলারের মূল্যের পণ্য। সব মিলিয়ে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৩%। অর্থাৎ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ১২২টি দেশ এগিয়ে আছে, আর পিছিয়ে রয়েছে ১০৪টি দেশ। বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকা দেশের মধ্যে একটি। আমেরিকায় ঋণখেলাপি থাকলেও তাদের টাকা বিদেশে পাচারের সুযোগ নেই; তবে বাণিজ্য ঘাটতি আছে। ফলে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিই হলো পণ্য আমদানি-রপ্তানি নিয়ে ঝগড়া করা।
প্রশ্ন হলো, উন্নত বিশ্বে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেন কি! উত্তর না। একটি আদর্শ পুঁজিবাদী দেশে শেয়ারবাজার হলো শিল্পপতিদের বড় ব্যাংক। তারা ঋণ নেন শেয়ারবাজার থেকে। শেয়ার ক্রেতারাও নিজেদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক মনে করেন। শেয়ারবাজার জুয়ার বাজার হলেও সেখানে গোপন বলতে কিছু নেই; তথা ধস শব্দ থাকলেও কেলেঙ্কারি শব্দ নেই। আমাদের দেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা এতই নিকৃষ্ট যে, ব্যাংক কর্মকর্তা শিখিয়ে দেন কীভাবে ঋণখেলাপি থেকে নাম কাটতে হবে। আমি কাছ থেকে একটি ঘটনা দেখেছি। একজন শিল্পপতি প্রায় ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেউলিয়া অবস্থা। তখন ব্যাংক পরামর্শ দেয়, যদি বাঁচতে চান তাহলে আবেদন করেন, আমার লাভের টাকা অনাদায়ী আছে, আমার শিল্প চালু রাখার জন্য ৫০ কোটি টাকা নতুনভাবে ঋণ দেওয়া হোক এবং সুদের টাকা মওকুফ করা হোক। অবশেষে সবার যোগসাজশে তিনি ৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কিস্তির টাকা পরিশোধ করেন এবং সেই সঙ্গে সুদের অর্ধেক ১২ কোটি টাকা মওকুফ পান।
সব মিলিয়ে তার কাছে রাষ্ট্র তথা জনগণ ঠকলো ২৭৪ কোটি টাকা। অথচ যারা আমাদের পেটের খাদ্য জোগান দিচ্ছে, তাদের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো নানারকম টালবাহানা করে থাকে। প্রধান উপদেষ্টার তথ্য সচিব বলেছেন, ‘আগে টাকা পাচার হতো বস্তায় ভরে; এখন হচ্ছে সুইচ টিপে’। রাজনীতিকরা মুখে বহু বড় বড় কথা বলেন বটে; কিন্তু বাস্তবে দেশকে কীভাবে স্বনির্ভর করবেন, কীভাবে আত্মমর্যাদাশীল জাতিতে পরিণত করবেন, কীভাবে দেশকে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত করবেন, কীভাবে সবার মধ্যে মালিকানা বোধ জাগ্রত করবেন- তাঁরা এসবের কোনো নজির আজ পর্যন্ত রাখতে পারেননি।
লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ