১৯৭২ সালে সেলিনা হোসেন লিখলেন গল্প ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, যা প্রথম ছাপা হয়েছিল তরুণ সাহিত্যিকদের পত্রিকা ‘টেরোড্যাকটিল’-এ। কিন্তু গল্প লিখে মন ভরছিল না সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের; তিনি গল্পটিকেই পরে উপন্যাসে রূপান্তর করেন। আর ১৯৯৭ সালে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাস থেকে সিনেমাও নির্মাণ করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেলিনা হোসেন হন শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার। একাধিক সাক্ষাৎকার ও লেখায় সেলিনা হোসেন বলেছেন, গল্পটি সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা সচেতনভাবেই উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষ্য, নারীরা স্বাধীনতার পটভূমিতে নেপথ্য শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর নারীদের অবদান নিয়ে বলতে গেলে অনেকেই বলেন ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এতে নারীদের অবদান একটি জায়গায় কেবল সীমাবদ্ধ করা হয়। অথচ নারীরা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, কখনো
সরাসরি, আবার কখনো নেপথ্যে। গল্পটি লেখার স্মৃতিচারণা করে সেলিনা হোসেন বলেন, আমাকে এ গল্পটি শুনিয়েছিলেন আমার শিক্ষক আবদুল হাফিজ। তিনি প্রাবন্ধিক, ফোকলোরবিদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন। তিনি আমাকে গল্পটি শুনিয়েছিলেন। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নামকরণ প্রসঙ্গে সেলিনা হোসেন বলেন, হাঙর হলো যে আক্রমণ করে, আর নদী বলতে আমি সারা দেশকে বুঝিয়েছি। আর গ্রেনেড হলো যুদ্ধের অস্ত্র। যে গ্রেনেড দিয়ে শত্রুকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের এক মায়ের সত্য ঘটনা নিয়ে উপন্যাসটি ১৯৭৪ সালে লেখা হলেও বই আকারে প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৭৬ সালে।
সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ যখন প্রথম ‘টেরোড্যাকটিল’-এ ছোটগল্প আকারে ছাপা হয়, সেটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন সত্যজিৎ। গল্পটির মধ্যে একটি ভালো চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। এ কথা জানতে পেরে সত্যজিৎকে চিঠি লেখেন সেলিনা হোসেন। সাহিত্যিক হিসেবে সেলিনা হোসেন তখনো নবীন। তাঁর চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন সে সময়ের নন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ। ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট সত্যজিৎ রায় সেলিনা হোসেনকে লিখেছিলেন, ‘‘আপনার চিঠি কিছুদিন হলো পেয়েছি। আমার নতুন ছবির কাজ এবং পুজোর লেখা নিয়ে একান্ত ব্যস্ত থাকায় উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল। টেরোড্যাকটিল পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার ছোটগল্পটি পড়ে আমার যে খুব ভালো লেগেছিল, তা আমি অনেককেই বলেছিলাম। গল্পটি থেকে ভালো চলচ্চিত্র হয়, এ বিশ্বাসও আমার ছিল। কিন্তু তখন আমার হাতে অন্য ছবি আসায় ওটার কথা চিন্তা করতে পারিনি। পরে বাংলাদেশে গিয়ে ছবি করার প্রশ্ন ওঠে আরেকবার; তখন শুনেছিলাম ওদিকের অবস্থা ভালো নয়, কাজে নানারকম অন্তরায়ের সম্ভাবনা আছে। সুতরাং পরিকল্পনাটি ‘স্থগিত’ থাকে।” গল্পটি অন্য কারও হাতে সিনেমা হলে কতটা শৈল্পিকভাবে চিত্রায়িত হবে, তা নিয়ে সংশয়ের কথাও জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ। পরে ’৭৮ সালে সেলিনা হোসেনকে আরেকটি চিঠি লিখেছিলেন সত্যজিৎ। তাতে তিনি লেখেন, ‘আপনার একটা চিঠি বেশ কিছুদিন আগে পেয়েছি, নানান ব্যস্ততা হেতু জবাব দেওয়া হয়নি। আপনার গল্প থেকে ছবি করার ইচ্ছা আছে, কিন্তু সেটা কবে পূরণ হবে জানি না। আমি আপাতত কিশোরদের জন্য একটা ছবি করছি। আপনার গল্পের প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে নিজেই লিখে জানাব।’ অবশেষে পর্দায় আনলেন চাষী নজরুল। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাস থেকে সিনেমা পরিচালনা, শিল্প নির্দেশনা ও চিত্রনাট্য করেছেন পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্রটি ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। সিনেমাটিতে অভিনয় করেন সুচরিতা, সোহেল রানা, ইমরান, অরুণা, দোদুল, রাজীব, মিজু আহমেদসহ অনেকে। ১৯৯৪ সালে মানিকগঞ্জের ঝিটকা গ্রামে সিনেমাটির দৃশ্যধারণ করা হয়েছিল।