সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি সপ্তাহেই নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে সারা দেশে নির্বাচনি আমেজ শুরু হয়েছে। নির্বাচনের জন্য বিএনপি এবং জামায়াত তাদের প্রাথমিক প্রার্থীদের নামও প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন পর তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য অপেক্ষায় আছে। এবারের নির্বাচনে কে জিতবে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়। ভোটারদের মনোভাব অস্পষ্ট। এক বছর আগেও মনে হচ্ছিল, এ নির্বাচনে বিএনপির জয় কেবল সময়ের অপেক্ষা। অনেকেই মনে করতেন, বিএনপির ক্ষমতায় আসার আনুষ্ঠানিকতা হবে আগামী নির্বাচন। কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে ততই নির্বাচনের ফলাফল অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। বিএনপি নেতারা তো বটেই, দলের কর্মীরা পর্যন্ত জোর গলায় দাবি করতে পারছেন না নির্বাচনে তাদের বিজয় অবধারিত।
আওয়ামী লীগের পতনের পর বিভিন্ন সংস্থা আগামী নির্বাচনের ওপর জরিপ করেছে। এসব জরিপে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির জনপ্রিয়তা এক জায়গায় থমকে আছে। কোনো কোনো জরিপে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির জনপ্রিয়তা কমারও তথ্য উঠে এসেছে। অন্যদিকে জামায়াতের জনপ্রিয়তা প্রতিটি জরিপেই বাড়ছে। সব জরিপে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাহলো ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোটার কাকে ভোট দেবেন সেটা বলছেন না। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে কোন দলকে ভোট দেবেন, এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি ৪৮.৫% উত্তরদাতা। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে বিএনপিকে ভোট দেওয়ার হার কমে ১২% দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরের জরিপে বিএনপিকে ভোট দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ১৬.৩% উত্তরদাতা।
অন্যদিকে, আইআরআইয়ের সেন্টার ফর ইনসাইটস ইন সার্ভে রিসার্চ গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের আটটি বিভাগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে। ‘ন্যাশনাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০২৫’ সম্প্রতি সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সর্বশেষ জরিপে বেশকিছু তথ্য উঠে এসেছে যা আলোচনার দাবি রাখে। রাজনৈতিক দলের পছন্দের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে ৫১ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-কে পছন্দ করে। অন্যদিকে ৫৩ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দ করেন বলে জানিয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগকে যথাক্রমে ৩৮, ৩৩ ও ২৫ শতাংশ মানুষ পছন্দ করেন। আগামী নির্বাচনে ভোট দেবেন কি না জানতে চাইলে ৬৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, তারা অবশ্যই ভোট দেবেন। এ ছাড়া ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন আরও ২৩ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে, মাত্র ৯ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন তারা সম্ভবত ভোট দেবেন না। আগামী সপ্তাহে ভোট হলে কোন দলকে ভোট দেবেন- এমন প্রশ্নে ৩০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বিএনপির কথা বলেছেন। যেখানে ২৬ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দেবেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। অন্যদিকে এনসিপিকে ছয় শতাংশ, জাতীয় পার্টিকে পাঁচ শতাংশ এবং ইসলামী আন্দোলনকে চার শতাংশ মানুষ ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। অন্য দলগুলোর ভোট রয়েছে ১১ শতাংশ। সাত শতাংশ ভোটার জানিয়েছেন, তারা কাকে ভোট দেবেন এখনো নিশ্চিত নন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেছেন ১১ শতাংশ ভোটার। এই জরিপে দেখা যাচ্ছে, পছন্দের দল হিসেবে বেশির ভাগ উত্তরদাতা জামায়াতের কথা বলেছেন। যদিও কাকে ভোট দেবেন সেই প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির পক্ষে বেশি মত এসেছে। কিন্তু এখানেও বিএনপির ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে জামায়াত। জরিপের জামায়াত মাত্র চার শতাংশ পিছিয়ে। কিন্তু এখন দলটি যে আটটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্য করছে, তাদের পক্ষে জনমত যোগ করলে ভোটের হিসাব পাল্টে যাবে। গত দেড় বছরে নানা কারণে বিএনপির জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও কমেছে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিএনপির বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বাড়াবাড়ি। দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, দখলদারির অভিযোগ। মনোনয়ন নিয়ে দলের ভিতরে দ্বন্দ্ব। দেশজুড়ে দলের অন্তর্কলহ। বিএনপি কী করতে চায় তা অনেক ক্ষেত্রেই অস্পষ্ট। দলটি নির্বাচনের দাবি নিয়ে যত সরব ততটা সরব না, মানুষের নিত্যকার সমস্যা নিয়ে। কারও কারও মনে এ ধরনের ধারণা হয়েছে যে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি সবকিছু উপেক্ষা করছে। এখানেই সাধারণ মানুষের ভুল ধারণা সৃষ্টির সুযোগ হয়েছে।
দলটি বিগত ১৫ বছর ছিল বিরোধী রাজনীতির ঐক্যের প্রতীক। সবদলকে নিয়ে গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি ক্রমশ যেন একলা হয়ে যাচ্ছে। দলটির গুরুত্বপূর্ণ জোটসঙ্গীরা আলাদা হয়ে গেছে। যেসব দল এখনো বিএনপির সঙ্গে আছে তাদের নিজস্ব স্বার্থটাই মুখ্য। এক ব্যক্তি নির্ভর এসব দল বিএনপির সঙ্গে আছে নির্বাচনে দু-একটি আসন পাবে বলে। এই দলগুলো বিএনপির জন্য সম্পদ না দায় সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তা ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরা নিয়েও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে।
অন্যদিকে এই সময়ে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ জামায়াত রাজনীতিতে নতুন নতুন চমক দেখাচ্ছে। দলটির নেতা-কর্মীদের শৃঙ্খলা সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে। তাদের পরিকল্পিত কৌশল ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিপুল সাফল্য জামায়াতের জন্য বড় অর্জন। দলটি রক্ষণশীল ইমেজ থেকে বেরিয়ে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চাইছে। জামায়াতে ইসলামী এর আগে কোনো জাতীয় নির্বাচনে দলের নেতাদের বাইরে কাউকে প্রার্থী করেনি। জামায়াতের প্রার্থীদের মধ্যে ন্যূনতম রুকন পদধারী নেতারা ছিলেন। এবার সেখানে দলটি কিছুটা শিথিল অবস্থান নিয়েছে। ভিন্নধর্মাবলম্বীদেরও এবার প্রার্থী করছে জামায়াত।
জামায়াতে ইসলামী এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কয়েক ধাপে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে। গত সপ্তাহে তিনটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করেছে দলটি। এর মধ্যে একটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজনকে প্রার্থী করা হয়েছে।
জামায়াতের সূত্র বলছে, আরও কয়েকটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের আলোচনা চলছে। অন্তত একটি আসনে হিন্দুধর্মাবলম্বী প্রার্থী প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আলোচনায় আছে, সেই আসনটি কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) হতে পারে। ওই আসনে বিএনপির প্রার্থী দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা (পদ স্থগিত) ফজলুর রহমান, যিনি গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য-কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব থেকে আলোচনায় রয়েছেন।
জামায়াতে ইসলামী যে তিনটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে খুলনা-১ আসনের প্রার্থী কৃষ্ণ নন্দীকে নিয়ে। তিনি জামায়াতের ডুমুরিয়া উপজেলা হিন্দু কমিটির সভাপতি।
এর আগে আসনটিতে বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতের আমির শেখ আবু ইউসুফকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। গত বুধবার আবু ইউসুফের বদলে কৃষ্ণ নন্দীকে প্রার্থী ঘোষণা করে জামায়াত। কৃষ্ণ নন্দীর বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে, যেটি খুলনা-পাঁচ আসনে পড়েছে। ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এক বছর ধরে তাঁর বিভিন্ন সমাবেশে কৃষ্ণ নন্দীকে দেখা গেছে। এসব সমাবেশে হিন্দুধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষও ছিলেন সরব।
কৃষ্ণ নন্দীকে জামায়াত প্রার্থী করেছে তাঁর নিজ এলাকার বাইরের বটিয়াঘাটা ও দাকোপ উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-১ আসনে। এই আসন ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৫ নামে ছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত একবার ছাড়া প্রতিবারই এখানে হিন্দু প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। অনেকের ধারণা, সেই হিসাব থেকে কৃষ্ণ নন্দীকে বেছে নিয়েছে জামায়াত। এই সিদ্ধান্ত থেকেই বোঝা যায়, জামায়াত অনেক ভেবেচিন্তে নির্বাচনি কৌশল নির্ধারণ করেছে। সময় যত গড়াচ্ছে ততই বিএনপির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াত। জামায়াতের নেতৃত্বে আট দল আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি জোট না করলেও আসন সমঝোতা করবে বলে জানা গেছে। এটিও বেশ কিছু আসনে বিএনপির জন্য মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
সবকিছু মিলিয়ে, আগামী নির্বাচন কোনো সহজ সমীকরণে হবে না। দিন যতই যাচ্ছে ভোটের হিসাব পাল্টে যাচ্ছে, ভোটারদের রং বদল হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন পর্যন্ত কোনো দলের পক্ষে জোয়ার আসেনি। এই নির্বাচন হতে পারে অনিশ্চয়তায় ভরা এক শ্বাসরুদ্ধকর নির্বাচন। যে নির্বাচনে ভোটাররা সব হিসাব পাল্টে দিতে হয়তো এখনো মুখে কুলুপ এঁটে আছে। ফলাফল যাই হোক, এ নির্বাচনে জয়ী হবে জনগণ।
শিরোনাম
- দীপাবলি শুধু একটি উৎসব নয়, জীবন্ত ঐতিহ্য : প্রণয় ভার্মা
- ইইউ’র দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনে যোগ দেবেন ৭ জার্মান নাগরিক
- খালেদা জিয়া চিকিৎসায় রেসপন্স করছেন: ডা. জাহিদ
- কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মতিনকে বদলি
- ‘মানুষ জানতে চায় ক্ষমতায় গেলে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের জন্য কী করবে’
- মৎস্য অধিদপ্তরকে আরও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে : ফরিদা আখতার
- আনঅফিশিয়াল ফোন নিবন্ধনে মার্চ পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় সুবিধা
- খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
- আসিফ ও মাহফুজের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা
- এনইআইআর সংস্কারের দাবিতে কারওয়ান বাজারে সড়ক অবরোধ
- সেন্টমার্টিনের আদলে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা কুতুবদিয়ায়
- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই আসনে এনসিপির প্রার্থী ঘোষণা
- সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমকর্মীদের অবদান রয়েছে: প্রধান বিচারপতি
- সূচক কমলেও ডিএসইর লেনদেন বেড়েছে
- বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন বিধিমালার নতুন গেজেট প্রকাশ
- জবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচন ২৪ ডিসেম্বর
- ১৫৯ জুলাইযোদ্ধার বিদেশে চিকিৎসা নিশ্চিত করেছে সরকার
- পদত্যাগপত্র জমা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ ও মাহফুজ
- ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান ধরে রাখলেন রোহিত
- একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
প্রকাশ:
০০:০০, সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
আপডেট:
০২:১৭, সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
পাল্টে যাচ্ছে ভোটের হিসাব
অদিতি করিম
প্রিন্ট ভার্সন
এই বিভাগের আরও খবর
সর্বশেষ খবর