ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হবে। ভোট গ্রহণের সময় ১ ঘণ্টা বাড়িয়ে ৯ ঘণ্টা করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলবে। চলতি সপ্তাহের শেষে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গতকাল নির্বাচন কমিশন সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। সকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে কমিশনের এ সভা হয়। চলে বিকাল পর্যন্ত। এতে চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিকালে বৈঠক শেষে কমিশন সভার বিস্তারিত তুলে ধরেন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, ৮ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যে কোনো দিন নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করা হবে। ভোট হবে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে যে কোনো দিন। তিনি উল্লেখ করেন, এবার ভোট গ্রহণের সময় ১ ঘণ্টা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলবে। যেহেতু এবার সংসদ ও গণভোট একসঙ্গে হচ্ছে এবং দুই ব্যালটে হচ্ছে, সে কারণে এ সময় বাড়ানো হয়েছে। কমিশন সভার সার্বিক সিদ্ধান্তের পর ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ নির্বাচন কমিশনার আরও জানান, কমিশনের এ সভায় আলোচ্য বিষয় ছিল, আইন এবং রীতির আলোকে তফসিল-পূর্ব এবং তফসিল-উত্তর কার্যক্রম। তিনি বলেন, ‘তফসিল-পূর্ব কার্যক্রমের মধ্যে কতগুলো রীতিগত রীতি অনুযায়ী কিছু কাজ আছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, এবার ভোটের দায়িত্বে ৯-১০ লাখ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন। এর মধ্যে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তারা রয়েছেন। তাদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি চূড়ান্ত হবে ভোটের আগেই। তিনি বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি-এখানে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের এ তালিকায় সংযুক্ত করব। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের আপাতত বিবেচনায় নিচ্ছি না। তারা রিজার্ভে থাকবে। একান্ত প্রয়োজন না হলে তাদের নেওয়া হবে না।’
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ভোটের কয়েক দিন আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হবে। সেই সঙ্গে ইসি স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনি সরঞ্জাম ভোটের আগের রাতে পৌঁছাবে। ভোট গ্রহণের সময় হবে ৯ ঘণ্টা। এবার ১ ঘণ্টা সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। গণভোটসহ দুই ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়ার সুবিধার্থে গোপন কক্ষ বাড়ানো হবে। তবে যেসব কক্ষে স্থান সংকুলান হবে সেসব কক্ষে একাধিক মার্কিং প্লেস, অর্থাৎ সিক্রেট বুথ স্থাপন করা হবে। তিনি জানান, গণভোট-সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণায় সরকার ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে; নির্বাচন কমিশন এতে সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া গণভোট সম্পর্কে ভোটাররা যাতে সহজে বুঝতে পারেন, সেজন্য প্রত্যেক কেন্দ্রে ব্যালট বড় আকারে ছাপিয়ে ভোটের লাইনের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হবে। এ ছাড়া পঙ্গু, বয়স্ক এবং সন্তানসম্ভবা মাসহ যাদের সহায়তা প্রয়োজন-তাদের ভোটের ব্যাপারে একটা সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হবে।
তিনি জানান, পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে কমিশন সভায়। এরই মধ্যে সোয়া ২ লাখ প্রবাসী নিবন্ধন করেছেন। ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধনের সময় রয়েছে। দেশের ভিতরে তিন ধরনের ব্যক্তি তফসিলের পর থেকে ১৫ দিন তথা ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধনের সুযোগ পাবেন। আবুল ফজল বলেন, ‘দুই ধরনের পোস্টাল ব্যালট আছে। দেশের ভিতর থেকে এবং দেশের বাইরে থেকে পোস্টাল ভোটিং। দেশের বাইরের ব্যালটগুলো সোমবার থেকে ছাপানোর কাজ শুরু করছি। মঙ্গলবার থেকে এটা বিদেশে প্রেরণের কাজ শুরু হবে। আর দেশের ভিতরে যে পোস্টাল ব্যালটগুলোর জন্য নিবন্ধন কাজ শুরু করব- যেদিন তফসিল ঘোষণা হবে সেদিন থেকে। চলবে ১৫ দিনব্যাপী। যারা ভোট দিতে চান পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে দেশের ভিতর থেকে, তারা তফসিল ঘোষণার পর দিন থেকে শুরু করে মোট ১৫ দিন নিবন্ধন করতে পারবেন। এ নিবন্ধন সম্পন্ন হলে তাদের কাছে ইনকান্ট্রি পোস্টাল ভোটিং-এর ব্যালট চলে যাবে।’
তিনি জানান, এবারের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক এবং সাংবাদিকদের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকরা যেন নির্বিঘ্নে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন- এর জন্য যেসব সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন সে ব্যাপারে পরিপত্র জারি করা হবে। ভোটে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক বা কারও কোনো থাকা-খাওয়া ধরনের সহায়তা না নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে ইসি। সেই সঙ্গে এবার ভোটের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গেও বৈঠক করা হবে।
সোমবার থেকে আমরা আঞ্চলিক এবং সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জুম মিটিং করব। যেখানে বিভিন্ন বিষয়, নির্বাচন অফিস জড়িত সে-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হবে।
তিনি জানান, তফসিলের পরের কাজ নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার এবং প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং, পোলিং অফিসারদের নিয়োগ এবং পোস্টাল ভোটিং নিবন্ধনের সময়সূচির বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রম নিয়েও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি- যেদিন তফসিল ঘোষণা হবে সেদিনই সন্ধ্যাবেলায় আইনশৃঙ্খলা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ে জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারের সঙ্গে আমরা জুম মিটিং করব। পরবর্তীতে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর তাদের সঙ্গে ইসির সরাসরি আরেকটা বৈঠক হবে। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে একটি পরিপত্র এ সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে দেওয়া হবে। এর আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। স্ট্যাটিক ডেপ্লয়মেন্ট থেকে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পর্যন্ত সব ধরনের ফোর্সই কাজ করবে এবং কেন্দ্রে যে ধরনের ফোর্স ডেপ্লয় করা দরকার সেটা ডেপ্লয় হবে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনে একটা সেন্ট্রাল মনিটরিং সেল স্থাপিত হবে। যেখানে সব বাহিনী এবং প্রতিষ্ঠানের সংস্থার প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
নির্বাচনি পরিস্থিতি তথ্য সংগ্রহের জন্য অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করার কথাও জানান তিনি। অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ১৪ জনের কমিটি থাকবে। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ, নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ইসির আইন শাখা, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও এলাকাভিত্তিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এ কমিটি হবে।
ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি সম্পর্কে তিনি বলেন, তিন ধরনের আপনার বিচারিক কমিটি মাঠপর্যায়ে কাজ করে। ৩০০ আসনে ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি কাজ করবে। আচরণবিধি প্রতিপালন এবং নিশ্চিতকরণে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তফসিল ঘোষণার পরের দিন থেকেই প্রত্যেক উপজেলা বা থানায় দুজন করে ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করবেন। এ সংখ্যাটা শেষ পাঁচ দিনে অর্থাৎ নির্বাচনের আগের তিন দিন, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনের পরের দিন এটা বেড়ে যাবে। নির্বাচনি এলাকায় সব ধরনের অনুদান ত্রাণ ইত্যাদি বিতরণ সম্পর্কে যে নিষেধাজ্ঞা সে-সংক্রান্ত পরিপত্র যথাসময় জারি করা হবে। তবে এতে যে সোশ্যাল সেফটি নেটওয়ার্ক যেটা আছে যেখানে অনেকে বয়স্ক-ভাতা পেয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি এগুলোর ওপরে কোনো ধরনের বাধানিষেধ থাকবে না।
তিনি জানান, তফসিল ঘোষণা করব। সঙ্গে সঙ্গে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়ে সব ধরনের প্রচারসামগ্রী সরাতে নির্দেশনা দেবে ইসি। প্রচার-প্রচারণা যেগুলো রাজনৈতিক দলগুলো এরই মধ্যে করেছেন এবং ঝুলিয়েছেন এগুলো সরাতে হবে এবং এগুলো না সরালে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে নির্বাচনি আচরণবিধির আওতায়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের পরিপত্র যেগুলো জারি করা হয় সেগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রুটিন কাজ হিসেবে যথাসময়ে তা জারি হয়ে যাবে।
নির্বাচন কমিশনার জানান, ভোটের দিন সামনে রেখে যান চলাচলের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে অতীতে যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া ছিল সেটাই বলবৎ থাকবে। ভোট গ্রহণের দিন সাধারণ ছুটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এদিন সাধারণ ছুটি থাকবে। তিনি জানান, দুর্গম নির্বাচনি এলাকায় হেলিকপ্টার সহায়তার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনি মালামাল ব্যালট পেপার এবং ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের চলাচলের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার হবে। ব্যাংক এবং পোস্ট অফিস খোলা রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা ভোটে অংশ নিতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। উপদেষ্টা পরিষদের কোনো সদস্য পদে থেকে ইলেকশন করতে পারবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা যথাসময়ে দেখতে পাবেন। এটা সম্ভবত সম্ভব নয়।
বিএনপি চেয়ারপারসনের অসুস্থতায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তফসিল ঘোষণার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, এটার পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য আছে। এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য। নির্বাচন কমিশন তার স্বীয় বিবেচনায় আগের যে কমিটমেন্ট আছে এবং সরকারের যে পরিকল্পনা আছে সেই অনুযায়ী আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
এবার জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের অবস্থান হচ্ছে আইন যাদের পারমিট করবে, তারা ভোটে অংশগ্রহণ করবে।