তিনি বলিউডের ‘হি ম্যান’, তিনিই অভিনেতা ধর্মেন্দ্র। চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর হঠাৎই অসুস্থতার খবর আসে। তারপর প্রায় ২০ দিনের টানাপোড়েন। আগামী ৮ ডিসেম্বর ছিল তাঁর ৯১তম জন্মদিন। জন্মদিনের ১৪ দিন আগে সোমবার প্রয়াত হলেন অভিনেতা। তাঁর জীবনের চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
তাড়া করত যে স্বপ্ন
পাঞ্জাবের লুধিয়ানার নসরালি গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারের ছেলে ধর্মেন্দ্র কেভল কৃষ্ণ দেওল। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পাওয়া দিলীপ কুমারের ‘শহীদ’ সিনেমা দেখে তাঁর মনে দানা বাঁধে নায়ক হওয়ার স্বপ্ন। শৈশবে সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন গ্রামের পথে পথে। খুঁজতেন, কোথাও নিজের মতো দেখতে কাউকে সিনেমার পোস্টারে দেখা যায় কি না। রাতে যখন শুয়ে থাকতেন, মাথায় ঘুরত বম্বের রঙিন জগতের স্বপ্ন। ধর্মেন্দ্র নিজেই বলেছিলেন, ‘অসম্ভব স্বপ্ন দেখতাম। সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতাম, আমি কি কখনো দিলীপ কুমারের মতো হতে পারব?’
যেভাবে স্বপ্ন পূরণ
১৯৫৮ সালে ফিল্মফেয়ারের ট্যালেন্ট কনটেস্টে প্রথম হলেন ধর্মেন্দ্র। আয়োজকদের প্রতিশ্রুতি ছিল, এ প্রতিযোগিতার বিজয়ীকে নায়ক করে মুক্তি পাবে নতুন সিনেমা। কিন্তু সেই সিনেমা আর হলো না। তাঁর নিয়তি লিখেছিল অন্য গল্প। দুই বছর অপেক্ষার পর ১৯৬০ সালে অর্জুন হিংগোরানির ‘দিল ভি তেরা হম ভি তেরে’ দিয়ে শুরু হলো ধর্মেন্দ্রর বলিউডযাত্রা। ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায় ধর্মেন্দ্র অভিনীত প্রথম বাংলা সিনেমা ‘পারি’। ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় এর হিন্দি সংস্করণ অনোখা মিলন। দুই সিনেমাতেই নিজের আইডল দিলীপ কুমারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয় ধর্মেন্দ্রর।
কঠিন পথে হাঁটা
পথটা মোটেও সহজ ছিল না। প্রযোজকদের অফিসে হাঁটতে হাঁটতে জুতো ক্ষয়ে গেছে। এমনও হয়েছে, কয়েকদিন পেটে পড়েছে কেবল ছোলা। সেসব দিনের স্মৃতি স্মরণ করে ধর্মেন্দ্র বলেছিলেন, ‘মুম্বাইয়ে প্রথম দিকে গ্যারেজে থাকতাম। থাকার ভালো কোনো জায়গা ছিল না। একটা ড্রিলিং ফার্মে কাজ করতাম, বেতন দিত ২০০ রুপি। বাড়তি আয়ের জন্য ওভারটাইম করতাম।’
যেভাবে সফলতার দ্বারে
ধর্মেন্দ্র পরে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন ‘মাচোম্যান’। ‘শোলে’, ‘ধর্মবীর’, ‘ফুল অউর পাত্থর’, ‘মেরা গাঁও মেরা দেশ’, ‘সীতা অউর গীতা’ সিনেমায় ধর্মেন্দ্রর চরিত্রগুলো রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয়। ১৯৬৬ সালের ‘ফুল অউর পাত্থর’ তাঁর প্রথম মেগা হিট, যেখানে শার্ট ছাড়া উন্মুক্ত ঊর্ধ্বাঙ্গ দেখিয়ে তিনি দর্শককে হতবাক করে দেন। একই সঙ্গে জোটে প্রশংসা আর সমালোচনা। ১৯৬০ ও সত্তরের দশকের অন্য অনেক অভিনেতার মতোই জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মেন্দ্রর অভিনয়ও ধীরে ধীরে ‘হিরো-ইমেজ’ নির্ভর হয়ে যায়, যেখানে তার ‘হি-ম্যান’ ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে সংলাপভিত্তিক নাটকীয় অভিনয় হলভরা দর্শকদের শিস আর তালি কুড়াত। তবে উষ্ণ, আবেগময় অভিনয়শৈলী তাঁকে এনে দেয় ‘গরম ধরম’ খেতাব। পরে সেই ডাকনাম ব্যবহার করেই তিনি শুরু করেন বলিউড থিমের রেস্তোরাঁ চেইন ‘গরম ধরম ধাবা’। আশির দশকে ‘নওকর বিবি কা’, ‘গুলামি’, ‘ইনসানিয়ত কে দুশমন’, ‘লোহা’ সিনেমায় আবার ফিরে আসে ধর্মেন্দ্রর জনপ্রিয়তা। নব্বইয়ের দিকে সেই জৌলুসে ভাটার টান এলেও নিজেকে বদলে ধর্মেন্দ্র হয়ে ওঠেন ‘চরিত্রাভিনেতা’।
নির্মাণেও সফল
১৯৮৩ সালে বিজয়তা ফিল্মস নামে নিজের প্র্রোডাকশন হাউস খোলেন ধর্মেন্দ্র। ছেলে সানি দেওলকে ‘বেতাব’ সিনেমায় পর্দায় এনে শুরু হয় তাঁর চলচ্চিত্র ব্যবসার নতুন অধ্যায়। ১২ বছর পর ছোট ছেলে ববি পর্দায় আসেন ‘বারাসাত’ সিনেমা দিয়ে।
কানাকড়িও পাবেন না হেমা?
জীবনের প্রথম সিনেমা ‘দিল ভি তেরা হাম ভি তেরে’র জন্য পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন মোটে ৫১ টাকা। তবে সাড়ে ছয় দশকের বর্ণময় ফিল্মি ক্যারিয়ারে কালক্রমে প্রায় ৫০০ কোটির সম্পত্তি গড়ে তোলেন ধর্মেন্দ্র। স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে প্রয়াত ‘হি ম্যান’-এর সম্পত্তির পরিমাণ ৫০০ কোটি। মুম্বাইয়ের লোনাভলা অঞ্চলে ১০০ একর জমির ওপর তৈরি একটি বিলাসবহুল ফার্মহাউস রয়েছে ধর্মেন্দ্রর। সুইমিং পুল, থেরাপি এরিয়া, বাগান এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন সেই বাংলোর অন্দরসজ্জা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। এই ফার্মহাউসেই প্রথম স্ত্রী প্রকাশ কৌরের সঙ্গে জীবনের অন্তিম দিনগুলো কাটিয়েছেন ধর্মেন্দ্র। বর্তমানে যার আনুমানিক বাজারদর ১২০ কোটি টাকা। এই ফার্মহাউসের নিকটবর্তী অঞ্চলে ৩০টি কটেজের একটি রিসোর্ট তৈরির পরিকল্পনা ছিল কিংবদন্তি অভিনেতার। পাশাপাশি মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ি-জমি মিলিয়ে ১৭ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে ধর্মেন্দ্রর নামে। এ ছাড়াও চাষের জমি এবং কৃষিঅযোগ্য জমি মিলিয়ে ১.৪ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক তিনি। ২০২২ সালে হরিয়ানার কার্নল হাইওয়ের ধারে ‘হি ম্যান’ নামে এক রেস্তোরাঁ খোলেন ধর্মেন্দ্র। যে রেস্তোরাঁ ট্যুরিস্টদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল মাত্র মাসখানেকের মধ্যেই। ঘনিষ্ঠরা বলেন, এই রেস্তোরাঁ ছিল ধর্মেন্দ্রর ‘প্যাশন প্রজেক্ট’। জমি-বাংলো, রেস্তোরাঁর পাশাপাশি বিলাসবহুল গাড়ির বিষয়েও শৌখিন ছিলেন ধর্মেন্দ্র। তাঁর সংগ্রহে মার্সিডিজ-বেঞ্জ এস-ক্লাস, মার্সিডিজ বেঞ্জ ঝখ৫০০ এবং ল্যান্ড রোভার, রেঞ্জ রোভারের মতো দামি গাড়ি থাকলেও ধর্মেন্দ্রর কাছে সব থেকে ‘প্রিয় বাহন’ ছিল তাঁর ৬৫ বছরের পুরোনো একটি ফিয়াট গাড়ি। যেটা ১৯৬০ সালে বলিউডে পা রাখার বছরে কিনেছিলেন তিনি। এই কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির কানাকড়িও পাবেন না দ্বিতীয় স্ত্রী হেমা মালিনী। কারণ হিসেবে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের মত, প্রথম স্ত্রী প্রকাশ কৌরকে ডিভোর্স না দিয়েই হেমার সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ধর্মেন্দ্র। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের বিয়ে হিন্দু ম্যারিজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বৈধ নয়। তবে দ্বিতীয় পক্ষের দুই কন্যা এশা-অহনা বাবার সম্পত্তি পেতে পারেন উত্তরাধিকার সূত্রে।

গোপনে দিলীপ কুমারের বাড়িতে
বলিউড মোগল প্রয়াত অভিনেতা দিলীপ কুমারের সঙ্গে বরাবরই পারিবারিক সম্পর্ক ছিল ধর্মেন্দ্রর। তাঁর অভিনেতা হওয়ার অনুপ্রেরণাও যে দিলীপ কুমার, তাও বহু সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ধর্মেন্দ্র। আর সেই ‘আইডল’-এর বাড়িতেই রীতিমতো গোপনে ঢুকে পড়েছিলেন ‘বীরু’। অভিনয় জীবনে আসার প্রায় ছয় বছর আগে এমন এক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন তিনি।
সালটা ছিল ১৯৫২। ধর্মেন্দ্র তখন পাঞ্জাবের এক ছোট শহরের কলেজছাত্র। সেই সময় দিলীপ কুমারের ‘শহীদ’ ছবিটি দেখে তিনি এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে, তাঁর মনে এক অদ্ভুত ধারণা জন্ম নেয়- তিনি এবং দিলীপ কুমার যেন দুই ভাই। আবেগপ্রবণ ভাবনার বশবর্তী হয়ে লুধিয়ানা থেকে সোজা মুম্বাই আসেন ধর্মেন্দ্র। বান্দ্রায় দিলীপ কুমারের বাড়িতে পৌঁছে যান। ধর্মেন্দ্র সাহস করে সেই বাড়িতে ঢুকে দেখেন তাঁর আইডল দিলীপ কুমার সোফায় ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু তখনই হঠাৎ জেগে ওঠে অচেনা মানুষকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হতবাক হয়ে যান দিলীম কুমার এবং জোরে পরিচারককে ডাকেন। ধর্মেন্দ্র এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে যান। পরে তাঁর উপলব্ধি হয়, একজন তারকার ব্যক্তিগত পরিসরে এভাবে ঢুকে পড়াটা তাঁর মস্ত ভুল হয়েছে। এই ঘটনার ছয় বছর পর ধর্মেন্দ্র আবার মুম্বাই ফিরে আসেন এবং ফিল্মফেয়ার ট্যালেন্ট কনটেস্টে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিযোগিতায় জেতার মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করে তিনি ফের দিলীপ কুমারের সাক্ষাৎ পান। দিলীপ কুমার তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। আপন করে নিয়ে বড় ভাইয়ের মতো স্নেহের সঙ্গে নিজের অভিনয় জীবনের সংগ্রামের কথা শোনান। ধর্মেন্দ্র অবাক হয়ে শোনেন তাঁর ‘হিরো’র কথা।
কেন পাননি ‘সুপারস্টার’ তকমা
ছয় দশকের দীর্ঘ ফিল্মি ক্যারিয়ারে অ্যাকশন হিরো থেকে রোমান্টিক নায়ক- এমনকি অভিজ্ঞ চরিত্রাভিনেতা; সব ধরনের ভূমিকায় সাফল্য পেয়েছেন তিনি। তবে তাঁর নামের সামনে কখনো জুড়ল না ‘সুপারস্টার’ তকমা! এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। ৬৪ বছরের ফিল্মি ক্যারিয়ারে বক্স অফিসে ধর্মেন্দ্র দিয়েছেন ৭৫টি হিট ছবি। যা হিন্দি সিনেমায় কোনো লিড অ্যাক্টরের সর্বোচ্চ সাফল্য। যাঁদের তিনি ছাড়িয়ে গেছেন, তাঁরা হলেন- অমিতাভ বচ্চন- ৫৭টি হিট, রাজেশ খান্না- ৪২টি হিট, শাহরুখ খান-৩৫টি হিট, সালমান খান-৩৮টি হিট। তাহলে কেন কখনো ‘সুপারস্টার’ বলা হলো না তাঁকে? কারণটা অনেক। যখন ধর্মেন্দ্র ক্যারিয়ার শুরু করলেন, সেই সময়ে দিলীপ কুমার ছিলেন নায়ক চূড়ামণি। সত্তরের দশকে ‘সুপারস্টার’ খেতাব চলে গেল রাজেশ খান্না, তারপর অমিতাভ বচ্চনের মাথার মুকুটে। এ ছাড়া ধর্মেন্দ্রর বহু বড় হিট ছবিই ছিল মাল্টি-স্টারার বা দুই-নায়কের ছবি।
‘শোলে’, ‘ইয়াদোঁ কি বারাত’, ‘মেরা গাঁও মেরা দেশ’, ‘ধর্মবীর’ এই তালিকায় অন্যতম। আবার আশির দশকে তাঁর একক হিট থাকলেও সেগুলোর পরিসর ছিল তুলনামূলক ছোট, যেখানে অমিতাভ বা ঋষি কাপুররা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন বড় বাজেটে। ধর্মেন্দ্রর বিপুল পরিমাণ ছবির সংখ্যায় ছিল ১৫০টি ফ্লপ। যা কোনো বলিউড নায়কের জন্য দ্বিতীয় সর্বাধিক (মিঠুন চক্রবর্তীর পরে)। এই মিশ্র সাফল্যের হিসাবই তাঁকে কখনো ‘এক নম্বর সুপারস্টার’ হতে দেয়নি।
রাজনীতিতে
২০০৪ সালে রাজনীতিতেও যোগ দেন ধর্মেন্দ্র। রাজস্থানের বিকানির থেকে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। বিজেপির টিকিটে ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত এমপি ছিলেন তিনি।
জীবনের শেষ দিনগুলো
নেটমাধ্যমে আগাগোড়াই সক্রিয় ছিলেন ধর্মেন্দ্র। কখনো প্রিয় কবিতার পঙ্ক্তি, কখনো আবার জীবনের খুঁটিনাটি ভাগ করে নিতেন অনুরাগীদের সঙ্গে। অভিনেতার ইনস্টাগ্রামে এখনো জ্বলজ্বল করছে তাঁর শেষ পোস্ট।
২৬ সেপ্টেম্বর ধর্মেন্দ্র তাঁর ইনস্টাগ্রামে একটি ছবি শেয়ার করেছিলেন, নীল রঙের স্যুট পরে। মুখে সেই চেনা হাসি। সঙ্গে পোস্ট করেছিলেন হৃদয়ছোঁয়া একটি কবিতা, ‘আজকাল গাম-এ-দৌড়ান সে দূর, গাম-এ-দুনিয়া সে দূর... আপনে হি নাশে মে ঝুমতা হু।’ যার সারমর্ম, দুঃখ, পৃথিবীর আদবকায়দা, আর কিছুই ছুঁতে পারে না তাঁকে। নিজের মতো করে হয়তো নিজেকে নিয়েই মগ্ন ছিলেন অভিনেতা। এটিই ছিল শেষবারের মতো তাঁর গভীর অনুভূতির প্রকাশ। তাঁর জীবন-দর্শন। শারীরিক দুর্বলতার মাঝেও আত্মমগ্ন হয়েই শেষ কয়েকটা দিন কাটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন অভিনেতা। তখন থেকেই তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছিল। বলিউডের ‘হি-ম্যান’ ধর্মেন্দ্র ৮৯ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতেই স্তব্ধ হয়ে গেল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। মাত্র ১৪ দিন পরই তিনি পা দিতেন নব্বইয়ে। চলতি মাসের শুরুতে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হলেও চিকিৎসকরা তাঁকে বাড়িতেই পর্যবেক্ষণে রাখার পরামর্শ দেন।
কিন্তু সোমবার থেমে গেল ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বলিপাড়ায় চলা এক জীবন্ত কিংবদন্তির পথচলা।

‘ড্রিম গার্ল’ হেমা মালিনীর প্রেমে
সত্তর ও আশির দশকে বড় পর্দার বাইরেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ধর্মেন্দ্র। আর সেটা ড্রিম গার্ল খ্যাত অভিনেত্রী হেমা মালিনীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কারণে। ‘শোলে’, ‘সীতা অউর গীতা’, ‘ড্রিম গার্ল’সহ বহু সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করতে করতে কখন যেন তারা প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। প্রথম স্ত্রী প্রকাশ কৌরের ঘরে তখন ধর্মেন্দ্রর চার সন্তান-সানি, ববি, অজীতা, বিজেতা। হেমা মালিনীকে তিনি বিয়ে করেন ১৯৮০ সালে। গুঞ্জন ছিল, হেমাকে বিয়ে করতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ধর্মেন্দ্র। তাদের সংসারে জন্ম নেয় দুই কন্যা এশা আর অহনা।
হেমাকে বিয়ের দু’বছরের মাথায় নাকি ফের প্রেমে পড়েন ধর্মেন্দ্র। তা-ও আবার বয়সে ২৬ বছরের ছোট অভিনেত্রী অনিতা রাজের প্রেমে পড়েন। এর আগে একটা সময় অভিনেত্রী সুরাইয়ার রূপের পূজারি ছিলেন ধর্মেন্দ্র। শুধুই অনুরাগ নয়, ধর্মেন্দ্র একসময় সুরাইয়ার প্রেমেও পড়েছিলেন। এর পরে মীনা কুমারীর সঙ্গেও প্রেমের গুঞ্জন শোনা যায় তাঁর। যদিও অবশেষে হেমার সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয় তাঁর। এরপর প্রথম স্ত্রী প্রকাশ কৌরের সঙ্গে দীর্ঘ সাংসারিক অশান্তি শুরু হয় তাঁর। অভিনেতার জুহুর বাড়িতে নাকি ঢোকারও অনুমতি মেলেনি হেমার। অভিনেতা যখন গুরুতর অসুস্থ, তখনো এই নিয়মের নড়চড় হয়নি বলেই জানা যায়। তবে শোনা যায়, হেমার সঙ্গে বিয়ের পরেও অভিনেত্রী অনিতা রাজের প্রেমে পড়েন। অবশেষে গোটা বিষয়টির মধ্যে নাকি ঢুকতে বাধ্য হন হেমা। পরিস্থিতি নাকি বেশ কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তিনি। অনিতা রাজের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রেও নাকি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন হেমা।
একনজরে ধর্মেন্দ্র
দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া
ধর্মেন্দ্রর জন্ম ১৯৩৫ সালের ৮ ডিসেম্বর, পাঞ্জাবের হরিয়ানার কাছে শাহনেওয়াজ গ্রামে। তাঁর পুরো নাম ধর্মেন্দ্র দেওয়া কৃষাণ দেওল। ছেলেবেলায় স্কুলে যেতেন হেঁটে। ফাঁকে ফাঁকে স্বপ্ন দেখতেন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের। ধর্মেন্দ্র লালটন কালান সরকারি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশোনা করেন, পরে ফাগওয়ারার রামগড়িয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর আর আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া করা হয়নি ধর্মেন্দ্রর।
যেভাবে সেরা নায়ক
১৯৬০ সালে ফিল্মফেয়ার আয়োজিত প্রতিভা প্রতিযোগিতায় জিতে তিনি সিনেমায় সুযোগ পান। প্রথম ছবি ‘দিল ভি তেরা, হাম ভি তেরে’ দিয়ে বলিউডে পা রাখেন। কিন্তু জনপ্রিয়তা আসে ‘শোলা অউর শবনম’ আর ‘বন্দিনী’র পর। ষাটের দশকে ধর্মেন্দ্র হয়ে ওঠেন বলিউডের সেরা নায়ক। ১৯৬৯ সালে হৃষিকেশ মুখার্জি পরিচালিত ‘সত্যকাম’ ধর্মেন্দ্রর ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
ফিল্মে মাইলফলক
ধর্মেন্দ্রর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় মাইলফলক ‘শোলে’ (১৯৭৫)। জয়ের (অমিতাভ বচ্চন) সঙ্গে বীরুর (ধর্মেন্দ্র) জুটি হয়ে গেছে কিংবদন্তি। এরপর আসে ‘ধরম বীর’, ‘হুকুমত’, ‘তাহলকা’, সবই সুপারহিট। ১৯৮২ সালের ‘গজব’-এ ধর্মেন্দ্র অভিনয় করেন মানসিক প্রতিবন্ধী এক চরিত্রে। ১৯৭৫ সালের ‘চুপকে চুপকে’ সিনেমায় দেখালেন, কমেডিতে সমান পারঙ্গম তিনি। এক সময় তিনি ছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত অভিনেতাদের একজন।
আরও আলোচিত সিনেমা
ধর্মেন্দ্রর আরও আলোচিত সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘ফুল অউর পাত্থর’, ‘অনুপমা’, ‘সত্যকাম’, ‘মেরা গাঁও মেরা দেশ’, ‘ড্রিম গার্ল’ প্রভৃতি। তাঁর অভিনয়ে যেমন ছিল দাপট, তেমনি ছিল মায়া ও মানবিকতা। ‘হি-ম্যান’ উপাধি পেলেও তিনি ছিলেন কেবল পেশির নয়, হৃদয়েরও নায়ক।
গুরুত্বপূর্ণ ২০০৭ সাল
২০০৭ সাল ধর্মেন্দ্রর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর তিনি একসঙ্গে তিনটি ভিন্নধর্মী ছবিতে অভিনয় করেন, ‘জনি গাদ্দার’, ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ ও ‘আপনে’।
‘জনি গাদ্দার’ ছিল ক্ল্যাসিক থ্রিলার, যেখানে ধর্মেন্দ্র পুরোনো দিনের বলিউড ঘরানার সঙ্গে আধুনিক গল্পের মেলবন্ধন ঘটান। ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’-তে তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ বয়স্ক মানুষ, যিনি আবার জীবনের প্রেম খুঁজে পান। আর ‘আপনে’-তে তিনি বাস্তব জীবনের ছেলেদের (সানি ও ববি দেওল) সঙ্গে অভিনয় করে দর্শকদের চোখে জল এনে দেন।
যত সম্মাননা
১৯৯৭ সালে তিনি পান ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার। ২০১২ সালে ভারত সরকার তাঁকে দেয় পদ্মভূষণ, দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান। এ ছাড়া ১৯৯০ সালে পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, আর ২০১৭ সালে বাবাসাহেব আম্বেদকর অ্যাওয়ার্ড তাঁর দীর্ঘদিনের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়।
সফল ব্যবসায়ী
অভিনয় জীবনের পাশাপাশি ধর্মেন্দ্র ছিলেন সফল ব্যবসায়ীও। তাঁর আনুমানিক সম্পদের পরিমাণ ৬০ থেকে ৭০ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫০০ থেকে ৫৩৫ কোটি টাকার সমান। চলচ্চিত্রে অভিনয়, প্রযোজনা, বিজ্ঞাপন আর বিনিয়োগ, সব মিলিয়েই এই সম্পদ অর্জন করেন।