‘নায়কদের নায়ক’ আর ‘মুভি মোগল’ খ্যাত বলিউড অভিনেতা দিলীপ কুমারের ১০৩তম জন্মদিন আজ। তাঁর আসল নাম ইউসুফ খান। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর পেশোয়ারে জন্ম। ২০২১ সালের ৭ জুলাই মারা যান এই কিংবদন্তি মুভি মোগল। তাঁর বাবা সরওয়ার খান ছিলেন ফল ব্যবসায়ী। তিনি পুরো পরিবার নিয়ে পেশোয়ার থেকে বোম্বে চলে গিয়েছিলেন। সেখানেই পড়াশোনা এবং বেড়ে ওঠা ইউসুফ খানের। দিলীপ কুমারের জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
বগুড়ার অমিয়র হাত ধরে ফিল্মে
বলিউডে দিলীপ কুমারের অভিষেক হয়েছিল কয়েকজন বাংলাদেশির হাত ধরে। শুনেই খটকা লাগল তো? কিন্তু এটাই সত্য। দিলীপ কুমার ‘জোয়ার ভাটা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চিত্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন বগুড়ার সন্তান অমিয় চক্রবর্তী। এই অমিয় চক্রবর্তীর হাত ধরেই উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপ কুমার চলচ্চিত্রে আসেন। দিলীপ কুমারকে নিয়ে গবেষণা করেছেন চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক অনুপম হায়াত। গবেষণার একপর্যায়ে খুঁজে পান এই অভিনেতার নেপথ্যে বেশ কয়েকজন বাঙালির নাম, যাঁরা আবার বাংলাদেশের মানুষ। থিয়েটারের মানুষ হিমাংশু রায় ও দেবিকা বিলাত থেকে ফেরার পর সিনেমা বানানোর ঝোঁক চেপে বসে। বানালেন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘বোম্বে টকিজ’। দিলীপ কুমারকে নিয়ে বানালেন প্রথম চলচ্চিত্র ‘জোয়ার ভাটা।’ দিলীপ কুমার চলচ্চিত্রে অভিষিক্ত হলেন। হিমাংশু রায়ের বাড়ি মানিকগঞ্জে। হিমাংশু ছিলেন এ ছবির প্রযোজক ও অমিয় চক্রবর্তী পরিচালক।
যেভাবে দিলীপ কুমার হয়ে ওঠা
আসল নাম মহম্মদ ইউসুফ খান। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের পেশোয়ারে তাঁর জন্ম। ত্রিশ দশকের শেষ দিকে তাঁর পরিবার স্থায়ীভাবে মুম্বাইয়ে বসবাস শুরু করে। চল্লিশ দশকের শুরুতে পুনেতে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন তিনি। একটি ক্যান্টিন চালাতেন এবং স্থানীয় বাজারে শুকনো ফল সরবরাহ করতেন। দেখতে বেশ সুদর্শন ছিলেন ইউসুফ খান। সিনেমার প্রতি অদম্য নেশা ছিল। এই কারণে প্রায়ই ছুটে যেতেন সিনেমার শুটিং দেখতে। কখনো একা, আবার কখনো কলেজের সহপাঠী রাজ কাপুরের সঙ্গে। এভাবেই আসা-যাওয়ার মধ্যে একদিন বলিউডের তৎকালীন সুপারস্টার দেবিকা রানীর চোখে পড়েন। তিনি ইউসুফের কাছে জানতে চান উর্দু পারেন কিনা? পাকিস্তানি শুনেই দেবিকার পরের প্রশ্ন ছিল- তুমি অভিনেতা হতে চাও কি না। বাকিটা ইতিহাস। ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তখন ধর্ম কিংবা নামের একটি বিষয় ছিল। স্বভাবতই মুসলিম কোনো নামকে তারা নিতে পারবেন না। এমনটিই ধারণা ছিল দেবিকা রানীর। তিনি এটাও জানতেন, ইউসুফ খান নামটি একজন রোমান্টিক হিরোর জন্য মানানসই হবে না। এ বিষয়ে সুপরিচিত হিন্দি কবি নরেন্দ্র শর্মার সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জাহাঙ্গীর, ভাসুদেব ও দিলীপ কুমার- এ তিনটি নাম প্রস্তাব করেন। এর মধ্যে ‘দিলীপ কুমার’ নামটিই পছন্দ করেন নিজের জন্য। নাম পরিবর্তনের বিষয়ে ইউসুফ খানেরও বেশ আগ্রহ ছিল। তাঁর রক্ষণশীল বাবা তাঁর এই নতুন পেশার কথা যেন না জানতে পারেন। কারণ তাঁর বাবা সিনেমা জগতের মানুষদের নিয়ে তামাশা করতেন।
নেই তাঁর কোনো উত্তরসূরি
এক জীবনে নাম-যশ-খ্যাতি সবই পেয়েছেন দিলীপ কুমার। কামিয়েছেন অর্থও। এত কিছুর পরও একটা জায়গায় এসে থেমে যেতে হয়। এ সুপার স্টারের নেই কোনো উত্তরসূরি। ৯৮ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে ৫৫ বছরের দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন স্ত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে। কিন্তু কোনো সন্তান হয়নি। এ নিয়ে অবশ্য কোনো আক্ষেপ ছিল না এ কিংবদন্তির। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা সানন্দে মেনে নিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে একবার ভারতীয় গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দিলীপ কুমার বলেছিলেন, ‘এটা সত্যি যে, আমাদের সন্তান থাকলে দাম্পত্য আরও রঙিন হতো। তবে যোগ্য উত্তরাধিকারী নেই বলে আমাদের কোনো কষ্ট নেই। আমি মনে করি, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই আমাদের জীবনে এ শূন্যতা। আমি ও সায়রা এ অভাব মেনে নিয়েছি।’ সন্তান না থাকার শূন্যতা তিনি পূরণ করেছিলেন সায়রার ভাইকে দিয়ে। সায়রার ভাই সুলতান দিলীপ দম্পতির কাছে সন্তানের মতোই ছিলেন। পরবর্তীকালে সুলতানের ছেলেমেয়ে এবং নাতি-নাতনিই দিলীপ-সায়রার জীবনের বড় অবলম্বন হয়ে উঠেছেন।
লতার উর্দু উচ্চারণ ঠিক করেন
লতা মঙ্গেশকর এবং দিলীপ কুমারের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। মুম্বাইয়ের একটি লোকাল ট্রেনে দিলীপ কুমারের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের পরিচয় করিয়ে দেন সুরকার অনিল বিশ্বাস। ভালো গায়ক বা গায়িকা হয়ে ওঠার জন্য, সুন্দর কণ্ঠ, সুর-তাল-ছন্দ সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা থাকতে হয়। আর যেটা খুব বেশি দরকার তা হলো স্পষ্ট উচ্চারণ। শুধু একটা ভাষাতেই তো হলে চলবে না, সব ভাষাতেই সমান দখল থাকতে হবে। এ বিষয়ে লতা মঙ্গেশকরকে সেরা পরামর্শটা দিয়েছিলেন দিলীপ কুমার। সেই প্রথম পরিচয়ের সময় কথোপকথন ছিল এ রকম- সুরকার অনিল বিশ্বাস দিলীপ কুমারকে বলছেন, ‘ও হচ্ছে লতা। খুব ভালো গান গায়।’ সেটা শুনে দিলীপ কুমার জিজ্ঞাসা করেন, ‘তাই নাকি! কোথায় থাকে?’ তখন অনিল বিশ্বাস লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্কে বাকিটা বলেন। সব শুনে দিলীপ কুমার বলেন, ‘ও তার মানে লতা মারাঠি। মারাঠি হলে তো হিন্দিটা চলে গেলেও উর্দু উচ্চারণে সমস্যা হতে পারে। তাই লতার ভালো গায়িকা হয়ে ওঠার জন্য, শিগগিরই উর্দু শেখার ব্যবস্থা করা উচিত। বিশেষ করে তাঁদের কথা ভেবে, যাঁরা গানের সুরের পাশাপাশি গানের কথাও খুব মন দিয়ে শোনেন।’ লতা মঙ্গেশকর এমন পরামর্শ পেয়ে বলেছিলেন, ‘বড় ভালো পরামর্শ দিয়েছিলেন কুমার সাব। সত্যি কোনো বিষয়ে উন্নতি করার জন্য সে বিষয়টায় দক্ষতার সঙ্গে শেখা উচিত। তাই আমি বাড়ি গেলাম এবং আমার এক আত্মীয়কে বললাম কার কাছে ভালো উর্দু শেখা যায়? এরপরই আমি মৌলানা সফি ইমামের কাছে উর্দু শেখা শুরু করলাম। এরপর আমার উর্দু উচ্চারণ অনেক উন্নত হয়। ফলও পাই হাতেনাতে। ‘মুঘল-এ-আজম’ তো বটেই, ‘পাকিজা’ ছবির ‘মৌসম হ্যায় আশিকানা’ গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। সে গানের উর্দু উচ্চারণ বড় নিখুঁত।’
গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম
দিলীপ কুমারের সাফল্য কিংবা অর্জনের তালিকা দীর্ঘ। প্রায় ছয় দশকের ক্যারিয়ারে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সবচেয়ে বেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও তাঁর নাম রয়েছে।
ফিল্ম ফেয়ারে আটবার পেয়েছেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার। মনোনীত হয়েছেন ১৯ বার। ফিল্ম ফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৮০ সালে মুম্বাই শহরের সাম্মানিক শেরিফ পদটি অলংকৃত করেন তিনি। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য পেয়েছেন ভারত সরকারের সম্মাননা পদ্মভূষণ ও দাদা সাহেব ফালকে। পাকিস্তান সরকার তাঁকে ভূষিত করেছে ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ’ সম্মাননায়। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তাঁর ভাগ্যে জোটেনি।

দিলীপ কুমারের চুলের স্টাইল : অ্যা স্টাইল আইকন
কপালে ভি-শেপে একগুচ্ছ চুল আছড়ে পড়া জাতীয় ক্রেজে পরিণত হলো। দিলীপ কুমারের জীবনী লেখক মেঘনাথ দেশাই লিখেছেন, আমরা তাঁর চুলের স্টাইল, পোশাক, সংলাপ এবং আচরণগুলো অনুকরণ করতাম। পর্দায় তাঁর চরিত্রটা আমরা আত্মস্থ করার চেষ্টা করতাম। তিনি সাদা রং পছন্দ করতেন। প্রায়ই সাদা জামা ও কিছুটা ঢোলা সাদা প্যান্ট পরতেন। উর্দু কবিতা ও সাহিত্যে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। খুবই শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। একই সঙ্গে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, পাঞ্জাবি ও পশতু ভাষা জানতেন। এমনকি মারাঠি, ভোজপুরি, বাংলা ও পার্সিয়ান বুঝতেন ও কথা বলতে পারতেন। ৫০ থেকে ষাটের দশকে বাংলাদেশ ও ভারত, বলতে গেলে এ দুই দেশসহ গোটা উপমহাদেশের যুবক থেকে বৃদ্ধ সবার কাছে স্টাইল আইকন হয়ে উঠেছিলেন দিলীপ কুমার। বিশেষ করে এই অভিনেতার চুলের স্টাইল ছিল সবার কাছে অনুকরণীয়। চুল কাটার সেলুনগুলোতে কাস্টমারদের চুলের স্টাইল কেমন হবে তা বোঝাতে বড় করে দিলীপ কুমারের ছবি টানিয়ে রাখা হতো। সেলুনে তারকাদের ছবি টানানোর প্রচলনটা দিলীপ কুমারকে দিয়েই শুরু হয়। সবাই তখন সেলুনে গিয়ে বলত, ‘দিলীপ কুমার হেয়ার স্টাইল’ চাই। মানে সব বয়সি মানুষ তার হেয়ার স্টাইলে বুঁদ হয়েছিলেন তখন।