জনপ্রিয় নজরুল সংগীত শিল্পী এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা শাহীন সামাদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর গাওয়া গান মুক্তিসেনাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। মহান বিজয়ের মাসে এই শিল্পীর স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধের গল্প তুলে ধরেছেন- পান্থ আফজাল
বিজয়ের মাস নিয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?
আসলে বিজয়ের এই মাস এলেই মনটা গর্বে ভরে যায়। কারণ, নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে এ মাসে আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলাম। বাঙালি হিসেবে আমার জন্য এটা একই সঙ্গে আনন্দের ও গর্বের।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল?
তখন ১৪৪ নম্বর লেনিন সরণিতে বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসায় ছিল, ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন। সেখানেই দেখা হয় মুস্তাফা মনোয়ার, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, সৈয়দ হাসান ইমাম, তারেক আলী, মুসাদ আলী, বিপুল ভট্টাচার্য্য, শারমীন মুরশেদ, নায়লা, বুলবুল মহালনবীশ, লতা চৌধুরীসহ অনেকের সঙ্গে। আমাদের সংগঠনের সঙ্গে তখন পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবীরা সম্পৃক্ত ছিলেন। শিল্পী সংস্থায় প্রথমে ছিলাম ১৭ জন। পরে হয়ে গেল ১১৭ জন।
তখন কোনো সম্মানি পেতেন?
অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ছয়টি গান গাওয়ার জন্য পেয়েছিলাম ১০৫ টাকা। আর যারা গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতি থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়সহ অনেকেই ছিলেন তখন ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সঙ্গে। গান গেয়ে যে সম্মানি পেতাম তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা-শরণার্থীদের জন্য হাঁড়ি-পাতিল, খাবার, পানি, কম্বল কেনা হতো।
মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে গান করেছেন...
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৮। আমাদের কাজ ছিল শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান গাওয়া। আমরা পুরো নয় মাস পশ্চিমবঙ্গেই ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছি, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছি। মঞ্চ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আমাদের গান গাওয়ানো হতো। আমরা দিল্লিতেও এক মাস ছিলাম, যেখানে আমাদের কাজ ছিল শুধু গান গাওয়া।
মুক্তিযোদ্ধা তালিকার সঠিক দলিল আছে বলে মনে হয়?
আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক দলিল বলতে তেমন কিছুই নেই। আমরা যারা গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত থেকেছি সেটা ২৪ বছর পর উদ্ধার হয়। তারেক মাসুদের মুক্তির গানের পর সবাই জানলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। সব দলিলে, তথ্যে ফাঙ্গাশ পড়ে গিয়েছিল। এখন তো অনেকে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন, যারা সে সময় সম্পৃক্ত ছিলেন না।
সে সময় মুক্তির গানের সঙ্গে কারা যুক্ত ছিলেন?
সে সময় মুক্তির গানে আমি ছাড়াও আমাদের সংগঠনের শারমীন সুলতানা, স্বপন চৌধুরী, দেবু চৌধুরী, লতা চৌধুরী, নায়লা যুক্ত ছিল। সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন সানজিদা আপা, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহমুদুর রহমান। মুক্তির গানের শুটিংটা ছিল অনেক কষ্টের। একটা ভাঙা ট্রাকে করে ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম। কষ্টের ছিল সেটি।
‘রূপান্তরের গান’ নিয়ে জানতে চাই...
‘রূপান্তরের গান’ নামে আমাদের একটি স্ক্রিপ্ট ছিল। ‘রূপান্তরের গান’ শিরোনামে সাজানো হয়েছিল মুক্তি ও সংগ্রামী চেতনার গানগুলো। এটার স্কেচ করতেন মুস্তাফা মনোয়ার ও স্ক্রিপ্ট পড়তেন সৈয়দ হাসান ইমাম। অনেক অনুষ্ঠান করেছি। এই পাড়ের সব গুণী শিল্পীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কলকাতারও অনেক গুণী শিল্পী। গণসংগীতের সঙ্গে গাইতাম ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ প্রভৃতি।