রান্নাঘরের গ্যাসের চুলার লিকেজ থেকে সৃষ্ট আগুনে ঝলসে যাচ্ছে একেকটি পরিবার। পরিবারের বড় সদস্যদের সঙ্গে প্রতিটি দুর্ঘটনায়
মারাত্মকভাবে দগ্ধ হচ্ছে শিশুরাও। ঢাকার আবাসিক এলাকায় তিতাসের যে গ্যাস লাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে তা বেশ পুরোনো এবং জং ধরা। এসব লাইনে আবার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি সংখ্যক গ্রাহককে গ্যাস সরবরাহ করায় চাপও বেশি পড়ছে। ফলে লাইনগুলোতে লিকেজ হওয়ার ঝুঁকি থেকে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের তুলনায় গ্যাসের লিকেজ থেকে অগ্নিদুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য গ্যাসের লাইন থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা রোধে সরকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির ওপর তারা জোর দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্যে, ২০২৪ সালে রান্নাঘরে ২ হাজার ৪১১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শুধু চুলা থেকেই ৩ হাজার ৫৬টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আর গ্যাস সরবরাহ লিকেজ থেকে ৪৬৫টি অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে, আগুন জ্বালিয়ে কোনো স্থানে গ্যাসের লিকেজ হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করা ঠিক না। এ ক্ষেত্রে গ্যাসের লিকেজ হয়েছে সন্দেহ হলে সাবান পানি দিয়ে পরীক্ষা করে এতে বুদবুদ হচ্ছে কি না দেখা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে নির্ধারিত স্থানে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়। গ্যাস লিকেজ হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করতে গ্যাস ডিকেকটর ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া রান্নাঘরের ভেন্টিলেশন ঠিক রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজধানী ঢাকায় যে গ্যাস লাইন বসানো আছে তার কিছু ৫০ বছর পুরোনো। এগুলো থেকে গ্যাস লিক হওয়ার ঝুঁকি বেশি। আবার যে লাইন দিয়ে ৫০ জন গ্রাহকের লাইনে গ্যাস আসার কথা সে লাইন দিয়ে ৫০০ জন গ্রাহককে গ্যাস দেওয়া হয়। ফলে সেই লাইনে চাপ বেড়ে যাচ্ছে। পাইপলাইনগুলো দুর্বল হওয়ার কারণে এর চাপ নেওয়ার ক্ষমতাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই পাইপ লাইনগুলোতে জং ধরছে এবং যে লাইনগুলো খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা থেকেও গ্যাস লিক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। তারা আরও বলেন, অবৈধ গ্যাস লাইনের কারণেই বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। আবার গত দুই বছরে দেশে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প হয়েছে। এ সময় মাটির নিচে যে গ্যাসের পাইপলাইন আছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না তা নিশ্চিত না। এখানে লিকেজ হতেই পারে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এলাকায় ৭ ডিসেম্বর একটি বাসায় চুলার আগুন থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণে একই পরিবারের চারজন দগ্ধ হন। রান্নাঘরের গ্যাস চুলার লিকেজ থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটে। এর আগে একই দিন রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় একটি বাসায় গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে একই পরিবারের ছয়জন দগ্ধ হন। তার আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি বাড়িতে চুলার গ্যাস লিকেজ থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণে একই পরিবারের চারজন দগ্ধ হন। ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর বিসিক এলাকায় একটি বাড়িতে গ্যাস লিকেজ থেকে সৃষ্ট আগুনে শিশুসহ একই পরিবারের পাঁচজন দগ্ধ জন। তার আগে চলতি বছরের ২৪ মার্চ রাজধানীর বাড্ডার একটি আবাসিক ভবনে রান্নার চুলার গ্যাস থেকে আগুন ধরে দুই শিশুসহ একই পরিবারের চারজন দগ্ধ হন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, সারা দেশ থেকে মাসে অন্তত ৫০০ আগুনে পোড়া রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হন। এর এক-পঞ্চমাংশেরই মৃত্যু হয় এবং এর মধ্যে ৪০ শতাংশই গ্যাসের আগুনে দগ্ধ হন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস লিকেজের মতো ঘটনায় গ্রাহকদের গা-ছাড়া ভাবের কারণে অনেক সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। মাসে অন্তত একবার হলেও সবাইকে ঘরে গ্যাস লিক হচ্ছে কি না তা নিরাপত্তার স্বার্থে তদারকি করা প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় কোনো স্থানে বাতাস চলাচলের পথ বন্ধ থাকলে এবং সেখানে কোনো গ্যাস লিকেজ থাকলে সেটি তখন জমাটবদ্ধ গ্যাসে পরিণত হয়। তখন যে কোনো স্পার্ক বা ম্যাচের কাঠি জ্বালানো হলেই তা বিস্ফোরণে পরিণত হয়। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শহরে অসংখ্য অবৈধ লাইন আছে যে স্থানে ছোট-বড় লিকেজ হচ্ছে। পুরো পাইপলাইন সার্ভে করে অবৈধ সংযোগের মতো বিপজ্জনক পয়েন্ট চিহ্নিত করতে হবে এবং পুরোনো লাইনগুলোও একই সঙ্গে পরিবর্তন করতে হবে। আর এমনটি করা না গেলে কেউই বিপদমুক্ত হতে পারবে না।