সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার স্বনির্ভর হওয়ার সম্ভাবনা এবং প্রত্যাশা অটুট থাকে। ব্যক্তি স্বনির্ভর, পরিবার স্বনির্ভর, সমাজ স্বনির্ভর, সংস্থা স্বনির্ভর, দেশ স্বনির্ভর এই প্রত্যেকটি স্তর বা বলয়ের স্বনির্ভরতার আমূল উপাদানের সংখ্যার শঙ্কা, সম্ভাবনা, সমস্যা- এর ভিন্নতা ছিল, আছে, থাকবে। তবে সোনার হরিণতুল্য স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যভিত্তিক উপায়েরও ভিন্নতা রয়েছে। আমরা অনেক সময় নিজ নিজ অবস্থানের জায়গা থেকে স্বনির্ভরতার রূপকল্প এবং অর্জন চিত্রায়িত করে থাকি। এ বিষয়টি সবার জন্য সাম্য বা এক নয়, তা-ও স্বীকার করতে সমস্যা হয়। আমরা লক্ষ্য এবং উপায়কে গুলিয়ে ফেলি। স্বনির্ভরতা যদি আমাদের লক্ষ্য হয় সে ক্ষেত্রে আমাদের উপায় সামর্থায়ন (মানবিক শিক্ষা, সাধারণ প্রশিক্ষণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ) এবং অর্থায়ন। আমরা কেন! জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের ব্যক্তিবর্গও লক্ষ্য এবং উপায়কে গুলিয়ে ফেলে। যেমন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুশাসন পাওয়া লক্ষ্য হলে তার উপায় হচ্ছে ভালো নির্বাচন। ভালো নির্বাচন মানে সবাই নির্বিঘ্নে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ভোট নিজ নিজ পছন্দ মোতাবেক উপযুক্ত প্রার্থীকে নির্বিঘ্নে দিতে পারবে এবং সবাই বিশ্বাস করবে ভোট ভালো হয়েছে। এই উপায় বাস্তবায়ন হলেই না ভালো রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য অর্জন হবে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, গণতন্ত্র নামক উপায় দ্বারা সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্য অর্জনের ধ্যানধারণা অপেক্ষা গণতন্ত্র নামক উপায়কেই দীর্ঘদিন আমরা লক্ষ্য মনে করে আসছিলাম। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নামক বিশাল ও ঐতিহাসিক অর্জনের নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশে বর্তমানে নেই, থাকলেও খুবই দুর্বল। প্রিয় পাঠক, আমার বড় ভাই মাওলানা পীর আবদুর রহমানের সঙ্গে মহাস্থান খানকা শরিফে যেতাম। অনেক শরিয়ত, মারফত, আধ্যাত্মিকতার ওয়াজ শুনতাম। দরবেশ সাহেবরা বলতেন, মানুষের বিবেকে আধ্যাত্মিকতার দ্বারা আবৃত থাকবে। কিন্তু বিবেক যদি বুলন্দ না হয় সেই আধ্যাত্মিকতা (Sprituality) অবলম্বনে বিপদ আসবে।
যা হোক আমার লেখার লক্ষ্য ও উপায় দ্বারা সম্ভবত মিল খাচ্ছে না। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী, জনদরদি, মানবসেবী পরিবার মরহুম ডা. মোজাফ্ফর রহমানের নাতনি/দৌহিত্রী মিতুলী মাহবুবের নিজস্ব কষ্টে উপার্জিত অর্থে মিতুলী ফ্যামিলি ট্রাস্ট সৃষ্টি করে বগুড়ার হতদরিদ্র পরিবারকে স্বনির্ভর করার লক্ষ্য অর্জনের জন্য উপায় হিসেবে মিতুলী ফ্যামিলি ট্রাস্টের মাধ্যমে সুদমুক্ত মানবিক ঋণ তহবিল সরবরাহ করে থাকেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক মানের রোটারিয়ান, AKS । তাঁর মরহুম পিতা পিডিজি আলী মাহবুব রোটারি ইন্টারন্যাশনালের মেজর ডোনার ছিলেন। তাঁর নানা মরহুম ডা. মোজাফ্ফর রহমান সমাজদরদি, টিএমএসএসের জন্মলগ্ন থেকেই পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি তাঁর সুযোগ্য কন্যা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক গোল আফরোজ মাহবুবকে টিএমএসএসের প্রতি এবং আমার প্রতি সদা সহানুভূতির সঙ্গে সক্রিয় থাকার নির্দেশ দেওয়ায় এই দানবীর গোষ্ঠী বরাবরই টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আই কেয়ার সেন্টার, ক্যানসার সেন্টার, লিম্ব সেন্টার ইত্যাদিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দান-অবদান দিয়ে আসছেন; যা টিএমএসএসের কাছে খুবই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
স্বনির্ভরের বহুমুখী সংকটের অন্যতম কারণ স্বনির্ভরের সংজ্ঞার ভিন্নতা আছে। অর্থনীতিতে চৌবাচ্চা তত্ত্ব (বাথটাব থিওরি) বলে যে তত্ত্ব থাই বংশোদ্ভূত গিয়া নামক অশোকার প্রশিক্ষক প্রায় পাঁচ বছর আমাকে গ্রুমিং করেছিলেন। আমি তার লক্ষ্য মোতাবেক চলছি কি না, জানি না। কারণ মাঠে অনুশীলন করতে গিয়ে তাঁর কথাগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেলাতে পারি না। কারণ স্টেকহোল্ডারদের তরিকা ঠিক নাই, বুজসুজ পরিষ্কার নেই। যেমন পাঁচ সদস্যের একটি অতিদরিদ্র পরিবারের সম্পদের পরিমাণ কোনো মতে গাদাগাদি চাপাচাপি হয়ে রাত কাটানোর একটি ছাপড়া, শেড নামক বাড়ি এবং ওই পরিবারের স্বামী নামক একজন পুরুষ, স্ত্রী নামক একজন মহিলা, মা, বাবা, শ্বশুর, শাশুড়ি এই চারজনের মধ্য থেকে গড় অবিরত একজন বয়োবৃদ্ধ নির্ভরশীল ব্যক্তি (ঘূর্ণায়মানভাবে এই চারজনের প্লাস কেউ না কেউ একজন নির্ভরশীল এসে থাকেই)। সন্তানসন্ততি, ভাইবোন, শ্যালকশ্যালিকার মধ্যে থাকে গড় দুজন নির্ভরশীল। ওই পরিবারে সম্পদ নামক উপযোগী ব্যক্তি মাত্র দুজন স্বামী ও স্ত্রী। সমাজবদ্ধ ধর্মীয় অনুভূতিসম্পন্ন বাংলাদেশের এই দম্পতির পুরুষের সারা বছর কর্মের নিশ্চয়তা নেই। শারীরিক অসুস্থতা, নারীর কর্মোপযোগিতা দুর্লভ। ফলে এই জাতীয় পরিবার তাদের পর্বত বোঝাতুল্য পরিবার পরিচালনা করার চ্যালেঞ্জ, ঝুঁকিতে হতাশাগ্রস্ত। এ জাতীয় পরিবারকে শুধু খেয়েপরে বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে, অবলম্বন হিসেবে তহবিল এবং তদারকি দিতে হলে তাদের স্বনির্ভরতা অর্জনের কর্মচক্র কত বড়, চক্রের সংখ্যা কত বেশি হবে, কতবার হবে তা নির্ভর করবে তার আইজিএ/উদ্যোগের মূলধন, অন্যান্য সহযোগিতা এবং সহায়ক তদারকির ওপর।
মিতুলী ফ্যামিলি ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা তথা মুখ্য ট্রাস্টি মিতুলী মাহবুবের স্বামী আকতার হোসেন আমাকে ভিডিও কলে বললেন, স্বনির্ভরতার লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে উপায়/অবলম্বনের বৈচিত্র্যময় ভিন্নতাকে মেনে নিতে হবে। আকতার হোসেন ওয়াশিংটন ডিসিতে থেকে গোটা পৃথিবীতে অ্যামাজন নামক কোম্পানির নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বাংলাদেশের প্রতি অনুগ্রহ, আগ্রহের কমতি নেই। তাই তিনি বললেন, অর্থ/সুদমুক্ত ঋণের ব্যবহার এবং অন্যান্য উপযোগিতা যদি সঠিকভাবে না থাকে সে ক্ষেত্রে অর্থ অপচয় হবে। ক্ষুদ্রতা নাজুক (Small is vulnerable), বৃহত্তরতা নাজুক নয়, ঝুঁকিমুক্ত (Big is sustainable)। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ হতে গেলে কতটা চক্র লাগবে এটারও ভিন্নতা থাকবে অর্থাৎ সব ক্ষেত্রে একসমান হবে না। চোখ দিয়ে দেখতে হবে, হৃদয় দিয়ে ভাবতে হবে। ঋণ বিতরণ অনুষ্ঠানে মুখ্য ট্রাস্টির মামা, টিএমএসএসের বৈদেশিক উপদেষ্টা, লন্ডনবাসী, বিলাত-বাংলাদেশ সমিতির শীর্ষস্থানীয় নেতা মো. মোস্তাফিজুর রহমান পল্টু ভাগনি মিতুলীর বক্তব্য উপভোগ করছিলেন। মাঝেমধ্যে আমাকে ইশারা দিচ্ছিলেন, মাইক্রো পর্যায়ের অনুশীলনগত জ্ঞান এবং ম্যাক্রো পর্যায়ের তাত্ত্বিক জ্ঞান বিবেচনায় রাখতে হবে। চৌবাচ্চাতত্ত্বের অর্থনীতি মোতাবেক স্বনির্ভর হতে গেলে চৌবাচ্চার ধারণক্ষমতা Inlet Flow (Income) and Outlet Flow (সম্পদের ব্যবহার/ভোগ- Expenditure) এই দুইয়ের অনুপাত আমলে নিতে হবে। স্বনির্ভর পরিকল্পনায় যদি খেয়েপরেই শুধু নয় উন্নয়ন চাই সে ক্ষেত্রে Inlet চক্রের ভিন্নতা থাকবে। মিতুলী ফ্যামিলি ট্রাস্ট থেকে সুদমুক্ত ঋণ তিনবার দিতে হবে, না পাঁচবার দিতে হবে এটা অনুশীলনিক, প্রায়োগিক গবেষণা হলে বোঝা যাবে। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র আমেরিকার ঋণ সর্বাধিক। পৃথিবীর মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদহীন অতি উন্নত ঋণমুক্ত এশিয়াভুক্ত রাষ্ট্র জাপান তাদের বুদ্ধিমত্তা, কারিগরি জ্ঞান, নৈতিক জ্ঞান, সার্বিক জ্ঞান ইত্যাদি দ্বারা স্বপ্নের ও শান্তির দেশে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় তথা রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি সৃষ্টির পূর্বশর্ত হিসেবে মানুষের মানবিক গুণাবলি দল ধরে উন্নয়ন করার ডামাডোল সবারই বাজাতে হবে। নচেৎ স্বনির্ভরতা দিবাস্বপ্ন হিসেবেই থেকে যাবে। সাধু সাবধান!
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস
ইমেইল: es@tmss-bd.org