১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পে মারাত্মক ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় এক ফাঁকে কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ফেরার পথে একটি রেস্টুরেন্টে খেতে বসে দারুণ একটি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমরা দুজন টেবিলে বসে ওয়েটারকে খাসির মাংস আছে কি না, জিজ্ঞেস করায় জবাব না দিয়ে সে কিচেনের কারও উদ্দেশে বলে ওঠে, ‘ঠাকুর এরা তো মোছলমান!’ অতঃপর ঠাকুরের নির্দেশে সে আমাদের প্লেট না দিয়ে কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করেছিল। আর আমাদের মোছলমান বলার মাজেজা ছিল, সেখানকার হিন্দুধর্মাবলম্বীরা খাসির মাংসকে পাঁঠার মাংস বলে থাকে!
তবে ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার যে আমাদের সেদিনের ওয়েটার ছেলেটির মতো সেই অর্থে মুসলমান বা মোছলমান জ্ঞান করছে কি না, সে প্রশ্ন এসে যায়। কারণ বিজেপি দলটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি বরাবরই বিরাগভাজন! এ অবস্থায় ভারতের নিজ রাজ্য কাশ্মীরের পাশাপাশি আশপাশের অন্যান্য এলাকার মুসলিম জনগোষ্ঠীও মোদি সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে এবং বাংলাদেশের ওপরও তাদের শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে! এত দিন সে দেশে অন্তর্ঘাতমূলক কোনো কর্মকাণ্ড ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তার দায়ভার যেভাবে পাকিস্তানের ঘাড়ে চাপানো হতো, এখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও একই কায়দায় অভিযোগ এনে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে এবং ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা দায় চাপিয়ে বাংলাদেশকে চাপে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশি মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে ভারত তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে চাচ্ছে! অথচ ভারত সরকার ভালো করেই জানে, বাংলাদেশ একটি শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠীর দেশ হিসেবে ধীরে ধীরে বিশ্বদরবারে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। এ অবস্থায় অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর ইচ্ছা বা সময় বাংলাদেশের নেই। কিন্তু এসব জেনেবুঝেও ভারতের বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে শান্তিতে থাকতে দিতে চায় না! কারণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ওপর দাদাগিরি ফলানো ভারতের অন্যতম একটি নীতি হয়ে উঠেছে। আর সেই প্রতিবেশী দেশটি একটি মুসলিম রাষ্ট্র হলে তো কথাই নেই! আবার এ ক্ষেত্রে ভারতের নিজ রাজ্য কাশ্মীরের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তারা কী বা কোন চোখে দেখে, সে বিষয়টিও সবারই জানা। আমি নিজেও কাশ্মীর ভ্রমণকালে সেখানকার মুসলমানদের দুরবস্থা দেখে এসেছি। কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা তাদের লড়াই অব্যাহত রাখায় সেখানকার সাধারণ মুসলমানদের অবস্থা দেখে আমিও ব্যথিত হয়েছি। সেখানকার সাধারণ
মানুষ যারা লড়াই-সংগ্রামে সংশ্লিষ্ট নেই তারাও যেভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে নিষ্পেষিত, নির্যাতিত সে বিষয়টিও অত্যন্ত দুঃখজনক। এখানে ছোট্ট একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই তার সামান্য একটি প্রমাণ পাওয়া যাবে। কাশ্মীরের শ্রীনগরে অবস্থানকালে এক সন্ধ্যায় একটি মোড়ে আট-দশজন বয়স্ক মানুষকে বসা দেখে তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখানে বিফ কাবাব এবং নানরুটি কোথায় পাওয়া যাবে? সঙ্গে সঙ্গে আমাকে চুপ করিয়ে অত্যন্ত ভয়ার্ত এবং বেদনাহতভাবে আস্তে করে তারা বলেছিলেন, কথাটি নিরাপত্তা বাহিনী শুনলে আমার বিপদ হবে! অথচ ভারতের অন্য একটি রাজ্য কেরালা গিয়ে রেস্টুরেন্টের সামনের খোলা জায়গায় রাস্তার ধারে বসে আমরা বিফ কাবাব খেয়েছিলাম। এখানে পার্থক্য হলো, কেরালা মুসলিম-অধ্যুষিত বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য নয়!
আবার কাশ্মীর ছাড়াও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের অনেক স্থানেই কোনো মুসলিম গরুর মাংস ক্রয়বিক্রয় করেছে জানতে পারলে তাদের কুপিয়ে হত্যা করা হয়! ভারতের বর্তমান সরকারের বিজেপিদলীয় লোকজন এবং আরএসএসের ক্যাডার বাহিনী এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত! গণমাধ্যমের বিভিন্ন দৃশ্যে দেখা গেছে, একজন মুসলিম নাগরিক থলিতে করে খাসির মাংস নিয়ে ঘরে ফেরা অবস্থায় টেম্পোর মধ্যেই তার থলিতে মাংস দেখতে পেয়ে কোনো কথা না শুনেই সেখানেই তাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়! আবার কোনো কোনো গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে হাঁড়িতে চড়ানো মাংস লাঠি পেটা করে বা লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে সেসব বাড়ির মহিলা-পুরুষ সদস্যদের মারধর করার দৃশ্যও আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখতে পেয়েছি! আমরা আরও দেখতে পেয়েছি মসজিদ থেকে নামাজ আদায় করে বের হওয়ার সময় মুসল্লিদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বীরত্ব প্রকাশ করছে এবং জুমার দিন মসজিদে স্থানসংকুলানের অভাবে মসজিদসংলগ্ন খালি স্থানে নামাজ আদায় করার সময় কীভাবে তাদের বুট দিয়ে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে! আর এসব ঘটনা বা দৃশ্য ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলেও একজন মানুষ হিসেবে আমাদের আহত করে। অথচ ভারত সরকারের তাতে কিছুই আসে যায় না, কারণ ভারত এ অঞ্চলের সুপার পাওয়ার!
এ ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের মুসলিমবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিতে গেলে স্থানসংকুলান হবে না বিধায় সংক্ষেপে এখানে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে এখন আবার ৩০০ বছরের পুরোনো মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গাবাদে থাকা আওরঙ্গজেবের কবর গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে এবং ভারতের শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কাউন্সিল নতুন যে পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়েছে, সেখানে মোগল সম্রাট আকবর এবং মহিশুরের শাসক টিপু সুলতানের নাম থেকে ‘গ্রেট’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে! আর এসব ঘটনাই প্রমাণ করে যে মোগল সম্রাট তথা মুসলিম শাসকদের প্রতি বিজেপি সরকারের ঘৃণা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। অথচ ৭০০ বছরের মুসলিম শাসনামলে মুসলিম শাসকরা ভারতকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়ে সারা পৃথিবীতে ভারতকে এক অনন্য সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী সরকারের পক্ষে কোনো কালে কোনো সময়েই যা করা সম্ভব হবে না। কারণ মুসলিম শাসনামলে ভারতের জিডিপি ছিল ২৭ শতাংশ, ফলে সে সময়ে ভারতকে ‘সোনার পাখি’ বলে ডাকা হতো। অথচ যারা ভারতকে সোনার পাখিতে রূপান্তর করেছিলেন তাদের নামনিশানাই মুছে ফেলার জন্য বিজেপি সরকার উঠেপড়ে লেগেছে! এ অবস্থায় ভারতের বর্তমান সরকারের মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব এবং ঘৃণা যে হিটলারের ইহুদি বা আজকের নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিনিদের ওপর ঘৃণার সঙ্গে তুলনীয় সে কথাটিও অস্বীকার করার উপায় নেই!
১৯৭১ সালে কলকাতার একটি রেস্টুরেন্টের ওয়েটার আমাদের মোছলমান হিসেবে চিহ্নিত করে ঠাকুরের নির্দেশে প্লেটের পরিবর্তে কলাপাতায় খেতে দেওয়ার কথাটি উল্লেখ করে লেখাটি শুরু করেছিলাম। যদিও এ ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে আরও কিছু মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনা আমার চোখে পড়েছিল। যেমন আমাদের ক্যাম্পসংলগ্ন একটি গ্রাম্য বাজারে একজন মুসলিম পানচাষি ডালায় করে পান নিয়ে বিক্রয়ের জন্য অন্যদের সঙ্গে বসলে তাকে সেখানে বসতে না দেওয়ায় কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে তার দাঁড়ি ধরে টানতে টানতে দূরে সরিয়ে দেওয়া হলে তিনি বাজার থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে তার পানের ডালা নিয়ে বসতে বাধ্য হন! সেদিনের সে দৃশ্যটিও আমার মনে দারুণভাবে রেখাপাত করেছিল! কিন্তু যেহেতু ছোটবেলা হতেই আমি হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে স্কুলে লেখাপড়া করেছি, খেলাধুলা ওঠাবসা করেছি, পূজার সময় আমোদ-আহ্লাদ, খানাপিনা করেছি এবং ঈদের সময় তারাও এসে আমাদের বাড়িতে খানাপিনা করেছে, সুতরাং আমার চিন্তাচেতনায় কখনো কোনো কমিউন্যাল মনোভাব ছিল না বা এখনো নাই। কিন্তু ভারতের বর্তমান সরকার যেভাবে মুসলিমবিদ্বেষী হয়ে উঠেছে এবং এ ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে যেভাবে টার্গেট করছে সে অবস্থায় স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে ভারতের এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করা দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলেই মনে করছি। আর সেই সঙ্গে ভারতের বর্তমান সরকারের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারপ্রচারণাসহ তাদের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিকারের বিষয়টিও বিবেচনায় আনা জরুরি বলে অনুভব করছি।
ভারত যেভাবে আমাদের সঙ্গে আচার-আচরণ শুরু করেছে তাতে আমাদের মনে হতেই পারে যে ভবিষ্যতে তারা আমাদের পার্বত্য এলাকায় উসকানি দেওয়াসহ তাদের চিকেন নেক বলে কথিত এলাকার প্রস্থ বাড়ানোর চেষ্টা বা ষড়যন্ত্র করতে পারে এবং সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তারা আমাদের ওপর প্রক্সি যুদ্ধ বা এই ধরনের একটা কিছু এমনকি সরাসরি যুদ্ধও বাধাতে পারে! কারণ চিকেন নেক নিয়ে ভারত ভীষণ চিন্তিত। আর তাদের সেই চিন্তার কারণ হলো চীন। এ অবস্থায় আমাদের মুখে হাত দিয়ে বসে থাকলে চলবে না, বিষয়টি নিয়ে আমাদেরও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে, আমাদের প্রতি ভারতের বৈরী মনোভাবকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে প্রতিকারের একটি রাস্তা বের করতে হবে। শক্তিসামর্থ্যে যেহেতু ভারত আমাদের অপেক্ষা কয়েক গুণ বড়, সুতরাং বিকল্প পদ্ধতিতে আমাদের টিকে থাকতে হবে। প্রয়োজনে চীনের মতো শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে হবে, যাতে করে বিপদের সময় চীন আমাদের পাশে দাঁড়াতে পারে। তা ছাড়া আমাদের দেশের সক্ষম সব নাগরিকের জন্য প্রাথমিক সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি স্বল্পমেয়াদি সামরিক কোর্স বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, ‘Self help is the best help’। ১৮ কোটি মানুষের ৫ কোটি মানুষকে যদি স্বল্পমেয়াদি বা প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া যায়, তাহলেও আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে তা একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। মোটকথা ভারতের আধিপত্যবাদ বা মিয়ানমারের হুমকি এসব মোকাবিলায় দেশ ও জাতিকে শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ করতে যা যা করণীয় অনতিবিলম্বে তা করতে হবে। আশা করি বর্তমানে যাঁরা সরকারে আছেন এবং ভবিষ্যতে যাঁরা সরকারে থাকবেন এখন থেকেই বিষয়টি তাঁরা ভেবে দেখবেন।
লেখক : কলামিস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা