রাগ নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ পন্থা অবলম্বনের পরামর্শ দেন পণ্ডিতরা। কিন্তু অদুদ স্যার (প্রয়াত আবদুল অদুদ, স্কুলে আমাদের বাংলা পড়াতেন) বলতেন, রাগ নয়; প্রয়োজন বিরক্তি নিয়ন্ত্রণ। কারণ বিরক্তি থেকে রাগ উৎপন্ন হয়। কাজেই বিরক্তি না হওয়ার অভ্যাস গড়া চাই। সেটা কীভাবে?
‘মনে কর, তোর পাশের বাড়িতে কেউ জোরগলায় বেসুরো গাইছে, সঙ্গে বাজাচ্ছে উঁচা আওয়াজের হারমোনিয়াম’ বলেন অদুদ স্যার, ‘শুনতে শুনতে বিরক্ত হচ্ছিস। ছুটে গিয়ে পাশের বাড়ির গায়ককে থামতে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইচ্ছে হলেই তো হবে না! ভদ্রতাও রক্ষা করা চাই। সেজন্য আমার পরামর্শ হলো...।’
তিন রকম পরামর্শ দিলেন আমাদের বাংলার ওস্তাদ। এক. গিয়ে বলতে হবে-দয়া করে লো সাউন্ডে সংগীতচর্চা করুন। দুই. লো সাউন্ডের সংগীত যদি নামমাত্র মনে হয়, তাহলে নিজ ঘরের দরজা-জানালায় খিল দাও। তা সত্ত্বেও যদি সংগীত-নিপীড়ন না কমে, তবে নিজ কানে তুলো ঢুকিয়ে বধিরতা অর্জন উপাদেয়। তিন. তুলো প্রয়োগেও কাজ না হলে নিজেকে বলবে, পাশের বাড়িতে না, দোজখি আওয়াজটা আসছে ১০ মাইল দূর থেকে।
বিরক্তি দমনের দাওয়াই পেয়েছিলাম সল বেলো রচিত এক লেখায়। কানাডীয়-আমেরিকান লেখক সল বেলো (মৃত্যু : ৮৯ বছর বয়সে, ২০০৫ সালের ৫ এপ্রিল) ‘মানবিক বোধগম্যতা ও সমসাময়িক সংস্কৃতির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের জন্য’ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৬ সালে। বেলো লিখেছেন ‘দ্রুত রাগ কমাবে? ফুটবলে যে কায়দায় কিক দাও সেভাবে ফুলের টবে জোরসে মার লাথি। রাগের জায়গায় রাজত্ব শুরু করে দেবে পদযন্ত্রণা।’
সল বেলো প্রচুর লেখেননি। যা লিখেছেন তা-ই মুগ্ধতা অর্জন করে। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘হেন্ডারসন দ্য রেইন কিং’ বেশ সাড়া তোলে। বের হয় ১৯৫৯ সালে। সৈয়দ শামসুল হক বইটির বাংলা অনুবাদ করে নাম দেন ‘শ্রাবণ রাজা’। ১৯৭৯ সালে ঢাকায় সিপিবি অফিসের সামনের ফুটপাতের বিক্রেতা থেকে ‘শ্রাবণ রাজা’ কিনেছিলাম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোষ পরিহারের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা আকাশের দিকে তাকিয়ে তার বিশালত্ব উপলব্ধির চেষ্টা করা। বিটিভি প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদ রচিত এক নাটকে দেখলাম, রাগ সংবরণের
জন্য গৃহকর্তা (ভূমিকায় ছিলেন আবুল হায়াত) একের পর এক পানিভর্তি গ্লাস ভাঙছেন। ক্রোধ-রাগ-রোষের বিকল্প শব্দ ব্যবহার করতেন সন্দ্বীপ নানা। ইনি আমার মায়ের মামা শামসুল হক। যৌবনে ব্যবসা করতেন সন্দ্বীপে। মায়ের খালু, চাচা, মামা সবই তো নানা। পৃথকভাবে চেনার সুবিধার্থে এই নানা হয়ে গেছেন ‘সন্দ্বীপ নানা’।
বেলা ৩টার শো দেখতে সিনেমা হলে ঢুকেছি। ‘সবার উপরে’ ছবি দেখছি। অন্ধকারে দেরিতে এসে আমার পাশে বসলেন এক দর্শক। বিরতির সময় দেখি, আরে এ যে সন্দ্বীপ নানা! তিনি বলেন, স্কুলের দরজায় তালা ঝুলাইয়া দিয়া এখানে আইসা উত্তম-সুচিত্রার ক্লাস নিতাছ? আমি জানতে চাইলাম, তিনি এখানে কেন? তাঁর উত্তর, তোমার নানিজান সকাল ৮টা থেকে কাওয়ালি (মানে ঘ্যানর ঘ্যানর) শুরু করছেন। সংসারে মাঝেমধ্যে কাওয়ালির দরকার আছে। সমস্যা হলো, আজ শুরু করলেন তো করলেন, থামতেছেন না। তাই ওনারে বাকস্বাধীনতা ভোগ করতে দিয়া সিনেমা দেখনের ফ্রিডম এনজয় করতেছি। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে হয়তো আমিও ভাওয়াইয়া (রাগবশত যা-তা করা) গাওনে লেগে যেতাম।
২.
পাবনার ঈশ্বরদীর নিশি রহমান (বয়স ৩৮) নামের মহিলা কেমন করে আটটি কুকুরছানা মেরে ফেলার মতো নিষ্ঠুরতায় মেতে উঠেছিলেন? আমাদের প্রিয় হোমিও চিকিৎসক কাম ম্যাগাজিন এডিটর মনিরুল ইসলাম মানিক বলেন, সিঁড়ির নিচে ছানাগুলো হয়তো ‘কুঁইকুঁই’ করছিল। বাচ্চা কুকুরের কুঁইকুঁই ধ্বনি অনেকের কানে ভালোই লাগে। নিশির ভালো লাগেনি। ১৫ দিন ধরে কুঁইকুঁই শুনতে শুনতে বিরক্ত হন তিনি। দিনক্রমে বিরক্তি হয়ে গেল রোষ। তাই তিনি নিরীহ কুকুরছানা বধে মেতে উঠলেন। কুকুরছানার জায়গায় বাঘ বা সিংহের বাচ্চা যদি ওরকম করত তখন নিশি হতেন ভীতসন্ত্রস্ত। কেননা এদের মা নিরীহ নয়। নিরীহনাশে আমোদিত হয় মানবচিত্ত।
কুকুরছানা হত্যা ঘটনায় হইচই পড়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাই ২ ডিসেম্বর প্রাণিসম্পদ বিভাগ মামলা করলে নিশিকে প্রাণিকল্যাণ আইন-২০১৯-এর ৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। নিশির স্বামী হাসানুর রহমান নয়ন ক্ষুদ্র কৃষক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা। স্ত্রীর আচরণে তিনি মর্মাহত ও লজ্জিত। কুকুরছানা হত্যার জেরে নয়নকে সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি কোয়ার্টার ছেড়ে অন্যত্র চলেও গেছেন।
পশু ক্লেশ আইনে নিশি রহমানের দুই বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। অর্থদণ্ডও হতে পারে। কী ধরনের মানসিক অবস্থায় আটটি কুকুরছানাকে তিনি দুনিয়াছাড়া করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তা হয়তো তিনি আদালতে বলবেন। এখন কারাগারে বসে কৃতকর্মের জন্য তিনি কি অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন?
ছানা তো দূরের কথা, যে কোনো বয়সি পশুর ওপর নির্যাতন দেখলে আমি বাধা দিই। আমার মতো অনেকেই দেন। প্রয়াত বন্ধু শাজাহান কামাল তো নির্যাতককে বাক্যবাণে জর্জরিত করতেন। বলতেন, নিরীহকে পিষতে-কচলাতে বেশ মজা, না? যান তো দেখি, সিংহকে লাঠি মেরে আসুন। চিতাবাঘকে চার পা বেঁধে আছাড় মারতে পারবেন? গোখরো আর অজগরের গোশত দিয়ে কোপ্তা বানানোর সাহস আছে? নাই। গুর্দার জোশ টগবগিয়ে ওঠে খালি কুত্তা-বিলাই-বানর আর গরু-ছাগল-ভেড়া-মোষ দেখলে!
চৌমুহনী বাজারে এক বর্ষার দিনে ধরা পড়া পকেটমারকে পিটুনি দিচ্ছিল দশ-বারো ব্যক্তি। শাজাহান কামাল লাফ দিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির। প্রহারব্যস্ত জনতাকে ঘুসি মারতে মারতে তিনি বলেন, ‘য়্যাই! ছাগলের ছাগল, গাধার গাধা! তোরা পুঁটি সাইজের চোর পিটাইয়া বীর হবি? যা, সাহস থাকলে বোয়াল সাইজের চোররে ঠ্যাঙা। তা তো পারবি না। পারবি ক্যামনে! বোয়ালের সামনে তোরা তো কুঁচা চিংড়ি।’
আদুরে কুকুর আমারও ছিল একটি, নাম ‘টনি’। সুরমা রং লম্বাদেহী সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের জামিদার দেশিবিদেশি জাতের সংকরায়ণ করেন) জাতের সে। ওকে পেয়েছিলাম ওর তিন মাস বয়সকালে এক ম্যাজিস্ট্রেটের সৌজন্যতায়। টনি ছিল আমার প্রহরী, হুকুমবরদার ও মিত্র। একাত্তরে রণাঙ্গনে আমার যাত্রার পর থেকে মনমরা টনি চুপচাপ বসে থাকত উঠানের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বরই গাছের নিচে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে যোদ্ধারা একে একে ঘরে ফিরল। জানুয়ারি মাসের শুরুতেও আমার না-ফেরা দেখে অনেকেই ধরে নেয় ‘ও হয়তো বেঁচে নেই।’
৫ জানুয়ারি বেলা আড়াইটা। বরইতলায় বসে টনি ঝিমুচ্ছে। আমাদের বাড়ি থেকে ৫০০ ফুট পুব দিকে রেললাইন উত্তর থেকে দক্ষিণে গেছে। বাড়ির অদূরে স্টেশন। ট্রেন স্টেশনে ঢোকার জন্য আউটার সিগন্যাল পার হচ্ছিল। ট্রেনের শব্দ শুনে ‘আঁ-উ-উ’ হর্ষধ্বনি দিয়ে লাফ দিয়ে টনি ছুটতে থাকে স্টেশনের দিকে। আনন্দ-কান্নাজড়িত গলায় মা বললেন, ‘আমার তারু এসেছে।’ তারু আমার ঘরোয়া নাম এবং আমি ওই ট্রেনেই বাড়ি ফিরছিলাম।
টনি আমার জীবনে অক্ষয় স্মৃতির অংশ হয়ে রয়েছে। ওর কথা যখনই ভাবি (আমেরিকার রাষ্ট্রপিতাদের অন্যতম) বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের একটা কথা মনে পড়ে। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু তিনটি- পুরোনো বউ, পুরোনো কুকুর আর নগদ টাকা।’ ফ্রাঙ্কলিন তাঁর স্বদেশে সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে যা বলে গেছেন, আমি মনে করি আমার দেশের জন্যও তা দরকার। এ ক্ষেত্রেও তিনি ‘বিশেষ তিন’কে গুরুত্ব দিয়েছেন : ১. সততার সঙ্গে কর্তব্য পালন, ২. সাবধানে সঞ্চয়, ৩. নাগরিক দায়িত্বশীলতা অবলম্বন।
মার্কিন ডলারের ১০০ মানের নোটে বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের ছবি আছে। নোটে তাঁর ছবি মুদ্রণের যথার্থতা কী? প্রশ্নের জবাবে গবেষকরা ফ্রাঙ্কলিনকেই উদ্ধৃত করেন-‘টাকায় কতটা কেনা যাচ্ছে সেটা টাকার মূল্য চিহ্নিত করে না। যে ধারণা ও আস্থাকে টাকা জিইয়ে রাখে সেটাই টাকার মূল্য।’
৩.
কুকুরকেন্দ্রিক নানা কথার চর্চা হয়। যেমন : কুত্তার মতো মরতে চাই না। কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করবি না। ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম। শত চেষ্টায় সোজা করা যায় না কুকুরের লেজ ইত্যাদি। কুকুরের মৃত্যুর বৈশিষ্ট্য নিয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এক নিবন্ধে মন্তব্য করেন, আধুনিক যুদ্ধ অভিশপ্ত যুদ্ধ। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই এ যুদ্ধে মানুষকে কুকুরের মতো মরতে হয়। হেমিংওয়ে যাকে মানসগুরু মানেন সেই মার্ক টোয়েন বলেছেন, লড়াইতে নামা কুকুরের আকৃতি বড় কথা নয়। তাৎপর্যময় হচ্ছে কুকুরের মধ্যে যুদ্ধের আকৃতি।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসে বলেন, যখনই আমি উন্নত হই একটু ওপরে যাই তখনই একটা কুকুর আমার পিছু নেয়। কুকুরের নাম অহংকার। তবে কুকুরবিষয়ক সবচেয়ে চিন্তা উদ্রেককারী মন্তব্য করেছেন অ্যান্ডি রুনি এবং মহামতি চাণক্য। যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামখ্যাত রেডিও টিভি লেখক রুনি ৯২ বছর বেঁচেছিলেন। ১৯৭৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত তিনি সিবিএস নিউজ নেটওয়ার্কে সিক্সটি মিনিট নামক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বুদ্ধিদীপ্ত খোলামেলা মতামত দেওয়ার বেলায় তাঁর ছিল অনন্য দক্ষতা। রুনি বলেছেন, গড়পড়তা মানুষের চেয়ে গড়পড়তা কুকুর সুন্দর।
চাণক্য বলেছেন, ‘বহ্বাশী স্বল্পতুষ্ট : সুনিদ্র : শীর্ষচেতন :/ প্রভুভক্তশ্চ সুরশ্চ নেতব্যা : ষটশুনো গুনা :// অর্থাৎ- ‘খেতে পারে অনেক কিন্তু অল্পেই সন্তুষ্ট॥ নিদ্রা গভীর কিন্তু সহজেই জাগ্রত হতে পারে॥ প্রভুভক্তি পরাক্রমী॥ কুকুর থেকে এই ছয়টি গুণ শিক্ষণীয়।’
৪.
আট ছানা প্রসবকারী মা-কুকুর তার সন্তানদের না দেখে আর্তনাদ শুরু করলে উপজেলা পরিষদ আবাসিক এলাকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ছানা সন্ধানে নামেন। একপর্যায়ে তাঁরা নিশি রহমানের শিশুপুত্র আফানকে বলেন, ছানাগুলো কোথায় গেল জানো? সে বলে, ‘কোথায়ও যায়নি তো! ছানাগুলো বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে দিয়েছে আমার মা।’
এভাবেই পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বস্তাবন্দি প্রাণহীন আট কুকুরছানা। শিশুদের অনেক সৌন্দর্য। অন্যতম সৌন্দর্য তাদের সত্যবাদিতা। রুশ কথাশিল্পী ফিয়োদর দস্তয়ভস্কির ‘ইডিয়ট’ উপন্যাসের নায়ক বলে, ‘শিশুরা অনেক কিছু বড়দের চেয়ে বেশি জানে। দুর্ভাগ্যবশত তবু ওদের বোধবুদ্ধির গুরুত্ব দেয় না বাবা-মা। শিশুরা মূল্যবান পথনির্দেশনা দিতে পারে। ওরা মনোহর ছোট্ট পাখি। কী চমৎকার ভঙ্গিতেই না ওই পাখি আমাদের পানে তাকায়। হ্যাঁ, আমি ওদের পাখিই বলছি। কেননা পৃথিবীতে পাখির মতো সুন্দর আর কিছু নেই।’
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন