ভূগর্ভের পানি কমতে থাকায় বরেন্দ্র অঞ্চলে বিপদ বেড়েই চলেছে। গত দুই বছরে এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমেছে অন্তত ১০ ফুট। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি পানির স্তর নেমেছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নে, প্রায় ১৩ ফুট। এর মধ্যে ৮ ফুট ৯ ইঞ্চি নেমেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ঝিলিম ইউনিয়নে। এ অবস্থায় ভূমিধসের শঙ্কা বেড়ে চলেছে।
সরকারের পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাম্প্রতিক এক গবেষণা দেখা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলার ৪৭টি ইউনিয়ন অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা, ৪০টি ইউনিয়ন উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা এবং আরও ৬৭টি ইউনিয়ন মধ্যম পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সম্প্রতি পিকেএসএফ-এর এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছরই খরা মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার অবস্থা বরেন্দ্র অঞ্চলের নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাষের জন্য এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি উঠানো হচ্ছে দেদার। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অটোরাইস মিলের গভীর নলকূপ। এতে অব্যাহতভাবে নিচে নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সুপেয় পানির জোগান। বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ডাসকো ফাউন্ডেশন’। সংস্থাটির এর সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের (আইডব্লিউআরএম) জরিপে বাধাইড় ইউনিয়ন এলাকাকে নিরাপদ পানির জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপর ভূগর্ভস্থ পানি তোলা বন্ধে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। ডাসকো ফাউন্ডেশনের জরিপ থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলের তিন পৌরসভা ও ১৫ ইউনিয়নকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে বাধাইড় ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই ইউনিয়নে বিএমডিএ ৭০টি গভীর নলকূপ বসিয়েছে। ২০ বছর ধরে এলাকার ২ হাজার হেক্টরের বেশি জমি এসেছে সেচের আওতায়।
ডাসকোর আইডব্লিউআরএম প্রকল্পের সহকারী সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, একযুগ আগেও এই অঞ্চলে ৬০-৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে ১৬০ ফুট বা তার নিচে না গেলেও পানি মিলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০-৪৫ মিটার উঁচুতে অবস্থান করছে। ঝুঁকিপূর্ণ ইউনিয়ন ও পৌর এলাকাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে আবাদ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ঠেকাতে বিদ্যমান বড় পুকুর ও খাড়ি খনন করে ভূমির ওপরের পানি ব্যবহার বাড়াতে বলা হয়েছে। বাধাইড় ইউনিয়নের পরই দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির ভয়াবহ রকমের সংকট চলছে।
এরই মধ্যে গভীর নলকূপ চালু থাকলেও খাওয়ার জন্য তা দিয়ে পানি ওঠে না। ভূগর্ভস্থ পানির জোগান ফুরিয়ে আসছে। এটি পুনর্ভরণ না হলে এ অঞ্চল আরও সংকটে পড়বে।
পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) নির্বাহী প্রকৌশলী নিলয় কুমার দাস জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার হার ভয়াবহ। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় চার বছর তারা ৫০টি মেশিন স্থাপন করে পানির স্তর নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ৮৬ উপজেলার হাল খুবই নাজুক। মোট এলাকার ৭১ ভাগই পানির সংকটে আছে।