সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় মানুষের মাঝে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভূমিকম্প-ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কতটা অপ্রত্যাশিত হতে পারে, আমরা তা ভালোভাবেই জানি। কিন্তু প্রকৃতি নিজেই অনেক সময় দুর্যোগের আগমনি বার্তা পাঠিয়ে দেয় প্রাণীর আচরণের মাধ্যমে। বহু যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে-প্রাণীরা দুর্যোগ বুঝতে পারে মানুষের আগেই। আধুনিক বিজ্ঞানও ধীরে ধীরে এই ধারণাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভূমিকম্পের আগে অনেক প্রাণী অস্বাভাবিক আচরণ করে। মুরগি হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠে, কুকুর অকারণে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে, বিড়াল আশ্রয় খোঁজে, এমনকি গরু-ছাগল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পালানোর চেষ্টা করে-এমন নজির বাংলাদেশেও পাওয়া গেছে। ইতালির ল’আকুইলা ভূমিকম্প (২০০৯) বা জাপানের তোহোকু ভূমিকম্পসহ (২০১১) পৃথিবীর নানান প্রান্তে চালানো গবেষণা দেখিয়েছে, ভূমিকম্পের ১০-৩০ সেকেন্ড আগে ভূগর্ভে সৃষ্ট কম তীব্রতার কম্পন (পি-ওয়েভ) কিছু প্রাণী অনুভব করতে পারে, যা মানুষের পক্ষে ধরা সম্ভব নয়।
প্রাণীর দেহে বিশেষ ধরনের সংবেদনশীল রিসেপ্টর থাকে যার মাধ্যমে তারা মাটি, বাতাস বা পানির ক্ষুদ্রতম কম্পন, এমনকি বায়ুচাপের অল্প পরিবর্তনও টের পায়। ভূমিকম্পের আগ মুহূর্তে নির্গত ইলেকট্রিক চার্জ, বাতাসের আয়ন পরিবর্তন বা ভূস্তরের চাপ পরিবর্তনের কারণে তাদের আচরণ বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। এ কারণে ভূমিকম্পের আগেই পাখির ঝাঁক হঠাৎ উড়ে যাওয়া, পিঁপড়ার বাসা ত্যাগ, এমনকি সাপ-ব্যাঙের মাটির গভীর থেকে বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা দেখা যায়।
ঝড়-ঝঞ্ঝার ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। বায়ুচাপ কমে যাওয়া বা বাতাসের তীব্র পরিবর্তন অনেক প্রাণী আগেভাগেই টের পায়। বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আম্পান বা সিডরের আগে স্থানীয় মানুষ দেখেছেন, গবাদিপশু অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক হাঁটছে, পাখিরা হঠাৎ গাছ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে, কুকুর-বিড়াল লুকিয়ে পড়ছে।
তবে প্রাণীর আচরণ দুর্যোগ পূর্বাভাসের নির্ভুল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়, এটি শুধু একটি সম্ভাব্য পূর্বাভাস। তাই প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণ সহায়ক হলেও আমাদের মূল ভরসা হওয়া উচিত বিজ্ঞানভিত্তিক ভূমিকম্প মনিটরিং, আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কতা ও দুর্যোগ প্রস্তুতি। প্রকৃতি যে কখনো কখনো আগে জানিয়ে দেয়, এটি সত্য। কিন্তু সচেতনতা, বিজ্ঞান ও প্রস্তুতিই মানুষের নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়