রাতের ঘন অন্ধকারে আপনি যদি জঙ্গলে হাঁটেন এবং হঠাৎ গাছের গোড়া বা শুকনো পাতার ভিতর থেকে নীলচে আলো দেখা যায়, ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। দূর থেকে মনে হবে যেন কেউ নীল LED লাইট রেখে গেছে বা জোনাকির দল জড়ো হয়েছে। কিন্তু জাপানের অনেক গ্রামের মানুষ এই দৃশ্য দেখে অন্য কিছু ভাবেন-তারা বলেন, ওটা হলো জঙ্গলের ভূত! কারণ অন্ধকারে নীল আলো ছড়িয়ে থাকা এই অদ্ভুত জীবটিকে কাছ থেকে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না।
এই ‘ভূতুড়ে আলো’র আসল রহস্য হলো এক ধরনের বিরল মাশরুম, যার নাম মাইসেনা লাক্স-কোয়েলি। পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি জায়গায়, বিশেষ করে জাপানের আর্দ্র বনাঞ্চলে এই ছত্রাক জন্মায়। মজার বিষয় হলো, এরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে নীলচে আলো ছড়ায়। জোনাকি যেমন আলো দেয়, এই মাশরুমও তেমনই নিজের দেহের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে আলো তৈরি করে। অনেকগুলো একসঙ্গে জন্মালে পুরো জঙ্গল অবিশ্বাস্য সুন্দর নীল আভায় আলোকিত হয়ে ওঠে!
বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নন কেন এই মাশরুম আলো ছড়ায়। তবে ধারণা করা হয়, আলো দেখে ছোট পোকামাকড় আকৃষ্ট হয়, আর সেই পোকামাকড় মাশরুমের স্পোর ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। আবার কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন, আলো শিকারিদের ভয় দেখাতেও ব্যবহৃত হতে পারে। রহস্য এখনো পুরোপুরি উন্মোচিত নয়, আর এই রহস্যই হয়তো এই ছত্রাককে আরও রহস্যময় করে তোলে।
জাপানের পাহাড়ি গ্রামে এখনো গল্প ছড়িয়ে আছে রাতের জঙ্গলে হঠাৎ নীল আলো দেখা গেলে ওটা ভূত! শত শত বছর ধরে এসব গল্প মানুষের কল্পনায় জায়গা করে নিয়েছে। অন্ধকার জঙ্গলে মাটির কাছাকাছি নীল আলো জ্বলতে থাকলে কেউ ভয় না পেরে পারে? যদিও সত্য হলো, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। এটা শুধু একটি সুন্দর, জাদুকরী ছত্রাক।
এখনো বাংলাদেশে এই মাশরুমের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে পাওয়া যায়নি। তবে আমাদের দেশের আর্দ্র ও উষ্ণ জলবায়ুর কারণে তত্ত্বগতভাবে এ ধরনের ছত্রাক থাকার পরিবেশ তৈরি হয়। হয়তো কোথাও কেউ রাতের অন্ধকারে একে দেখে ফেলেছে, শুধু চিনতে পারেনি!
জঙ্গলের এই নীল ভূত আমাদের একটা বড় শিক্ষা দেয়, প্রকৃতির ভিতর এখনো অসংখ্য বিস্ময় লুকিয়ে আছে, যা আমরা দেখিনি বা খুঁজে পাইনি। আলো ছড়ানো এই ছোট্ট মাশরুম জানিয়ে দেয়, পৃথিবী এখনো রহস্যে ভরা, আর এই রহস্যই প্রকৃতিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়