সরকার যাচ্ছে, সরকার আসছে, থামছে না মাটি, পানি, জীববৈচিত্র্যের হুমকি নিষিদ্ধ পলিথিনের জয়রথ। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব সরকার পরাস্ত পলিথিন সিন্ডিকেটের কাছে। সবশেষ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পলিথিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। শুরু হয় অভিযান। ভোটের রাজনীতি না থাকায় সচেতন মহলের প্রত্যাশা ছিল-এবার পরাজিত হবে পলিথিন। তবে তথাকথিত অভিযান শুরুর ১৩ মাস পরও বাজারে নিষিদ্ধ পলিথিনের রাজত্ব অব্যাহত।
পরিবেশের জন্য হুমকি পলিথিনকে ২০০২ সালেই নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ। তখন কয়েক বছরের জন্য পলিথিন উৎপাদন বন্ধ হলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আবারও বাড়তে শুরু করে। এরপর বহুবার সরকার বদল হয়েছে। সেই সঙ্গে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বেড়েছে। নিষিদ্ধ পণ্যটি এক ধাক্কায় বাজার থেকে বিতাড়িত করেছে পরিবেশবান্ধব পাট ও কাপড়ের ব্যাগ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে দেশের সব সুপারশপে ও ১ নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযানের ঘোষণা দেয়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকারের এই নির্দেশ অমান্য করলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সেই হুঁশিয়ারির বাস্তব প্রতিফলন বাজারে দেখা যায়নি ১৩ মাসেও। উল্টো অভিযান চালাতে গিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তার মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। জব্দ অবৈধ মালামাল রেখেই চলে আসতে হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে-সরকারের চেয়েও কি পলিথিন সিন্ডিকেট শক্তিশালী?
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে পালিত হয় বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য-‘সুস্থ শহরের জন্য সুস্থ মাটি’। অথচ এই মাটির প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষিদ্ধ পলিথিন। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জামিলুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে বিভিন্ন অণুজীবের উপস্থিতিতে পচনশীল বস্তু থেকে প্রতিনিয়ত নতুন মাটি তৈরি হয়। মাটির অণুজীব (মাইক্রোবায়োম) জৈব পদার্থ পচিয়ে মাটিকে উর্বর করে। পলিথিন বা প্লাস্টিক থাকলে অণুজীব বাড়ে না। নতুন মাটি তৈরি হয় না। বন্ধ্যা হয় মাটি। আবার প্লাস্টিক বা পলিথিনের কারণে গাছ শিকড় বিস্তার করতে পারে না। মাটির পানি ধারণক্ষমতা কমে যায়। এতে ফসলের উৎপাদন কমে যায়। আপাতদৃষ্টে প্রভাবটা চোখে না লাগলেও ভবিষ্যৎ খুবই ভয়াবহ। কৃষিতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
তথ্যানুযায়ী, মাটি এবং এর অণুজীব মানুষের খাদ্যের ৯৮.৮% পর্যন্ত সরবরাহ করে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) পূর্বাভাস দিয়েছে যে, মানব কার্যকলাপ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, মাটির অবক্ষয় কৃষিখাদ্য ফলনের ২০-৮০% ক্ষতির কারণ হতে পারে। ইউনেস্কো (২০২৪) জানিয়েছে যে, বিশ্বের প্রায় ৭৫ শতাংশ মাটির গুণাগুণ অবক্ষয় হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এটা ৯০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা ৩.২ বিলিয়ন মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করবে।
এদিকে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, যার একটা অংশ পলিথিন। প্লাস্টিক বর্জ্যরে বড় অংশ পুনর্ব্যবহার হলেও পলিথিনের অধিকাংশ ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতিতে। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহার্য পলিথিন ও প্লাস্টিক বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। এসব অপচনশীল দ্রব্য কৃষিজমি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদীনালা, খালবিল ও সমুদ্রে পতিত হয়ে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও কৃষির মারাত্মক ক্ষতি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ধরনভেদে এসব প্লাস্টিক মাটিতে মিশতে সময় লাগে ২০ থেকে ৪৫০ বছর পর্যন্ত। পরিবেশবাদীরা বলছেন, ২৩ বছর আগে পলিথিন নিষিদ্ধ করার আগে একটা পলিথিন ব্যাগের দাম ছিল এক-দুই টাকা। মূল্যস্ফীতি ধরলে এখন সেগুলোর দাম হওয়া উচিত অন্তত ১০-১৫ টাকা। অথচ, বর্তমানে ২০-৩০ পয়সায় পলিথিন ব্যাগ মিলছে। দোকানিরা পণ্যের সঙ্গে পলিথিন বিনামূল্যে দিচ্ছে। তাদের মতে, পলিথিন বন্ধ করা শুধু সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে যে সরকারই আসে, তারাই পলিথিন সিন্ডিকেটের পকেটে ঢুকে যায়। এখানে আমলাতন্ত্রও জড়িত। চলে টাকার খেলা। পলিথিন কারখানা তো লুকিয়ে রাখা যায় না। তবু এগুলো খুঁজে পায় না! প্রতিদিন শত শত টন পলিথিন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রকাশ্যে উৎপাদন, পরিবহন, মজুত, বিক্রি হচ্ছে, সেখানে মোবাইল কোট গিয়ে খুচরা দোকানে অভিযান চালাচ্ছে, লিফলেট বিতরণ করছে। গত বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জে অভিযান চালিয়ে দুই কেজি পলিথিন জব্দ করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এগুলো হাস্যকর। তারা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর ইশতেহারে পলিথিন বন্ধের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে থাকা উচিত।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, পলিথিন শুধু দৃশ্যমান বর্জ্য নয়, এটি মাটির গঠন ও জীববৈচিত্র্যের জন্য এক নিঃশব্দ হুমকি। পলিথিনবিরোধী লড়াই শুধু প্রশাসনিক নয়, এটি এখন পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষার লড়াই। এ লড়াইয়ে প্রধান বাধা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের স্বার্থের সম্পর্ক। গত ১৩ মাসে সরকারের নানান অভিযান সত্ত্বেও মূল উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদাহরণযোগ্য জরিমানা এবং কমিউনিটি নেতৃত্বাধীন কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিস্থিতি বদলায়নি। ধীরে ধীরে ক্ষতি করা সিগারেট উৎপাদনের ওপর ৩০০% সম্পূরক শুল্ক থাকলেও স্থায়ীভাবে বহমুখী ক্ষতিকারক পলিথিনের ওপর দূষণ কর নেই। যতদিন পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ না হবে এবং সস্তা প্রকৃতিবান্ধব বিকল্প উপকরণের প্রচলন না ঘটবে, ততদিন পলিথিন আগ্রাসন ও মৃত্তিকার এই সংকট থামবে না।