ভয়াবহ রকমের বিষাক্ত হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকার বাতাস। গতকাল ছুটির দিনের সকালেও জনবহুল এই নগরের বাতাসের মান ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ক্ষতিকর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) ছিল ২১৮.৭ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ সীমার চেয়ে ৪৩ গুণ বেশি। আর এই দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিতে গিয়ে ভয়াবহ আকারে বাড়ছে হাঁচি, কাশি, সর্দি, হাপানি, অ্যালার্জিক কফ, নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের নানান রোগ।
বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা আইকিউ এয়ারের তথ্যানুযায়ী, গতকাল সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বায়ুমান সূচকে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ২৯৩, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। একিউআই স্কোর ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে স্বাস্থ্যকর, ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সহনীয়, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত স্পর্শকাতর শ্রেণির মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত খুবই অস্বাস্থ্যকর ও ৩০১ থেকে ৫০০ পর্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে ধরা হয়। ঢাকার গড় বাতাসের মান গতকাল সকালে ছিল দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার কাছাকাছি। তবে রাজধানীর অনেক এলাকার বাতাস তখন দুর্যোগপূর্ণ হয়ে ওঠে। কল্যাণপুরে এ সময় একিউআই স্কোর ছিল ৩৮৪, পল্লবীতে ৩৩০ ও গোরানে ৩৩৯। এসব এলাকার বাতাস তখন নিরাপদ সীমার তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ দূষিত ছিল। চলতি নভেম্বরের ২৮ দিনের মধ্যে এক দিনও নির্মল ছিল না ঢাকার বাতাস। তিন দিন সহনীয় মাত্রায় দূষিত। দুই দিন ছিল অসুস্থ, শিশু ও বয়স্কদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, বাকি দিনগুলো কখনো ছিল অস্বাস্থ্যকর, কখনো অতিমাত্রায় অস্বাস্থ্যকর।
এদিকে দূষণের সঙ্গে বাড়ছে সর্দি, কাশি, অ্যাজমাসহ শ্বাসতন্ত্রের নানান রোগ। কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতাল-ক্লিনিকে শ্বাসতন্ত্রের রোগী তিন মাস আগের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ হয়েছে। চার বছরের শিশু শাহীর রাইয়ান পরিবারের সঙ্গে থাকে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায়। চলাফেরা ও খেলাধুলার গণ্ডি নিজেদের বাসা থেকে সর্বোচ্চ বোনের স্কুল বা প্রতিবেশীর ফ্ল্যাট। তবে একটু দূরে কোথাও গেলেই শুরু হয় কাশি আর শ্বাসকষ্ট। গত সোমবার শীতের কাপড় কিনতে বাবা-মায়ের সঙ্গে মার্কেটে যায় শিশুটি। মঙ্গলবার থেকেই শুরু হয় অ্যালার্জিক কাশি, সর্দি আর শ্বাসকষ্ট। শাহীরের মা জানান, ওর জন্য এদিক ওদিক যাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। গত বছর ১৫ দিনেও কাশি ও শ্বাসকষ্ট ভালো না হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে অ্যালার্জি পরীক্ষা করাই। তাতে দেখা যায়, অ্যালার্জি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ১৫ গুণ বেশি। ধুলার মধ্যে গেলেই অ্যালার্জি বেড়ে যায়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, একটা মানুষকে শারীরিক, আর্থিক, মানসিক-সব দিক দিয়ে শেষ করে দিতে পারে বায়ুদূষণ। দূষিত বায়ু হাঁচি, কাশি, সর্দি, হাপানি, অ্যালার্জিক কফ, অ্যালার্জিক অ্যাজমা, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ফুসফুস ক্যানসারের মতো শ্বাসতন্ত্রের রোগ যেমন সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে দূষিত বায়ুতে ভাসমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা শ্বাসতন্ত্র দিয়ে রক্তস্রোতে মিশে বিপাক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করছে। এ জন্য কিডনি বিকল, লিভার বিকলের মতো রোগ বাড়ছে। আমরা এখন জীবনের বেশির ভাগ সময়ই ডাক্তারের চেম্বার আর হাসপাতালে দৌড়ে পার করছি। এতে স্বাস্থ্য খাতে খরচ বাড়ছে। আমাদের কর্মক্ষমতা কমছে, কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যক্তি ও রাষ্ট্র। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে অনেক আইন, অনেক নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তা দৃশ্যমান নয়।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরই বায়ুদূষণ রোধে একটি টাস্কফোর্স গঠন করার কথা জানিয়েছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। টাক্সফোর্সের দায়িত্ব ছিল ঢাকার রাস্তার ধুলা নিয়ন্ত্রণ, ভাঙা রাস্তা মেরামত এবং আইন প্রয়োগে কাজ করা। গত বছরের শেষ দিকে যখন দূষণে অস্থির নগরবাসী, তখন পরিবেশ উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, ধুলা, কালোধোঁয়া, ইটভাটা এবং কলকারখানার দূষণ কমাতে কাজ করা হবে। বায়ুদূষণকারী পুরোনো বাস তুলে স্ক্রাপ করা হবে। ঢাকার খোলা অংশ ঘাস দিয়ে ছেয়ে দেওয়া হবে।
তবে বায়ুদূষণ রোধে ঘোষিত এসব উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর সব গাছের পাতায় জমেছে ধুলার পুরু আস্তর। সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কালোধোঁয়া নির্গমনকারী বাস-ট্রাক। অসংখ্য রাস্তায় নির্মাণকাজ চলছে, কোথাও ছিটানো হচ্ছে না পানি। আগে শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশনকে সড়ক আইল্যান্ডের গাছে পানি ছিটাতে দেখা গেলেও বর্তমানে সেই চিত্র চোখে পড়ছে না। উন্মুক্ত ট্রাকে নির্মাণসামগ্রী পরিবহন অব্যাহত রয়েছে। রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী রাখা হচ্ছে। খোলা জায়গায় ঘাস লাগানোর কার্যক্রমই শুরু হয়নি।
উল্টো গত সপ্তাহে বাংলাদেশ টিওডি (ট্রানজিট-অরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট) চতুর্থ সেমিনারে পরিবেশ উপদেষ্টা নিজেই অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ঢাকার একেকটা বাস যেন চলন্ত দূষণ কারখানা। প্রতিদিন দেখছি এগুলো কালোধোঁয়া ছাড়ছে। বাসগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বছরের পর বছর আমরা সমস্যা নিয়ে কথা বলি, কিন্তু সমাধানের জন্য সাহসী সিদ্ধান্ত নেই না। তিনি আমলাতন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত করে শহরের বিভাজক ও খালি জমি সবুজায়নে সরকারি প্রক্রিয়ার জটিলতা ও ধীরগতির কথা তুলে ধরেন।