প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আজকের নারীসমাজ গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী নারী সমাজ। ভিন্ন নারী সমাজ। তারা গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের হাত ধরেই নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, এই নারীসমাজ শুধু নারীদের নয়, সবাইকে উজ্জীবিত করবে। সেজন্যই নারীদের উঁচু স্তরে ধরে রাখা দরকার। নারীদের সামনে রেখেই আমাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।
গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বেগম রোকেয়া দিবস-২০২৫ উদযাপন ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
পুরস্কারপ্রাপ্তদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা যুগান্তকারী পুরস্কার। এই নারীরা বেগম রোকেয়ার আদর্শকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তারা শুধু বাংলাদেশের না, সারা পৃথিবীর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। হতাশা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ১০০ বছর আগে রোকেয়া লিখেছেন, নারী-কন্যাদের লেখাপড়া শেখাও যাতে সে অন্ন উপার্জন করতে পারে। সেখান থেকে আমরা শিখতে পারছি না কেন? ১০০ বছর পরও আমরা আরেকজন রোকেয়া সৃষ্টি করতে পারিনি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। তিনি যেসব দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, যেসব স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন, সেই স্বপ্নকে আমরা আমলে আনতে পারিনি। কথা বলেছি কিন্তু অগ্রসর হতে পারিনি। কেন পারলাম না এটা খুঁজে বের করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে রোকেয়া সঙ্গে থাকলেই আমরা অগ্রসর হতে পারব।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ও গ্রামীণ ব্যাংকের শুরুর দিককার স্মৃতিচারণা করে নারীদের কঠিন সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, দুর্ভিক্ষের আঘাত প্রথমে আসে মেয়ে ও শিশুদের ওপরে। তিনি বলেন, আমরা দেখলাম, সবাই মেয়েদেরকে চিনে অমুকের মা, অমুকের স্ত্রী, অমুকের মেয়ে, নাতি-নাতনি পরিচয়ে। নাম জানে না। সমাজের একটা অংশ কীভাবে সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এটা তার নমুনা। আমরা নাম ঠিক করে দিলাম। নাম লিখতে শেখানোর জন্য হাতে কাঠি ধরিয়ে দিলাম। দিনরাত পরিশ্রম করে, চোখের পানি ফেলে তারা নাম লেখা শিখল... এটা ১০০ বছর পরের অবস্থা। অথচ, ১০০ বছর আগে বেগম রোকেয়া এই স্বপ্ন দেখেছিল, যা অবিশ্বাস্য। তিনি সমাজকে ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ঝাঁকুনি বহন করে নিয়ে যাওয়ার মতো ব্যক্তি আর আসেনি। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ি; ইকোনমিক্স অনার্সে অনেক ছেলে ছিল, মেয়ে ছিল মাত্র চারজন। কোনো কোনো বিভাগে মেয়েই ছিল না। এখন যে কোনো শিক্ষায়তনে মেয়ে শিক্ষার্থী উপচে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা এখন অর্ধেক-অর্ধেক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েদের হল কয়টা? আমাকে বলল পাঁচটা। আর ছেলেদের হল ১৩টা। এটা কেমন বিচার হলো? মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা তো আগে করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ।
যারা পুরস্কার পেলেন : প্রতি বছরের মতো এবারও নারীশিক্ষা, নারী অধিকার, মানবাধিকার এবং নারী জাগরণে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চার বিশিষ্ট নারীকে রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়। এ বছর নারীশিক্ষায় (গবেষণা) রুভানা রাকিব, নারী অধিকারে (শ্রম অধিকার) কল্পনা আক্তার, নারী জাগরণে (ক্রীড়া) ঋতুপর্ণা চাকমা ও মানবাধিকার ক্যাটাগরিতে নাবিলা ইদ্রিস বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছেন।
মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন : অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়’ করার ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
রংপুরে বেগম রোকেয়াকে স্মরণ : নানান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যুদিনকে ঘিরে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে পালিত হচ্ছে বেগম রোকেয়া দিবস। এই মহীয়সী নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গ্রামে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।
গতকাল সকালে পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়ার স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল আহসান। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, প্রদর্শনী, রোকেয়া মেলা, রোকেয়ার সাহিত্যকর্ম নিয়ে পাঠচক্রসহ নানান আয়োজন।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, নারী সমাজকে জাগিয়ে তুলতে, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে, অধিকার আদায় করতে এবং সামাজিক কুসংস্কার ভাঙতে বেগম রোকেয়া যে সংগ্রাম করে গেছেন, তা ইতিহাসে অনন্য। তাঁর লেখনি আজও নারী-পুরুষের সমতা, মানবিকতা, শিক্ষা এবং সামাজিক সংস্কারের আন্দোলনে প্রেরণার উৎস।
এদিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) দিবসটি উপলক্ষে একটি র্যালি বের করা হয়। এরপর ক্যাম্পাসে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বেরোবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলীর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মাছুমা হাবিব। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আজম এবং গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হোসেন উদ্দিন শেখর। এ ছাড়া রোকেয়া দিবস উপলক্ষে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।