বাংলার ইতিহাসের স্মরণীয় এক নাম রানি ভবানী। দান, শিক্ষা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, যোগাযোগ, চিকিৎসা ও ধর্মীয় কাজের জন্য তার সুনাম আজও মানুষের মুখে মুখে। স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে মহারানি হিসেবে অভিহিত করেছিলেন প্রজারা।
কিন্তু এককালের সেই মহারানির স্মৃতিবিজড়িত জমিদার বাড়ি আজ ধ্বংসের পথে। ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। ইতোমধ্যে তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার স্থান ভেঙে গেছে।
স্থানীয়দের মতে, সরকারি উদ্যোগে জমিদার বাড়িটি সংস্কার করা হলে একদিকে ধ্বংস ও দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা পাবে। অন্যদিকে বদলে যাবে ঐতিহাসিক নিদর্শন জমিদার বাড়ি এলাকার পরিবেশ।
মহীয়সী রানি ভবানী তার রাজ্য আদমদীঘিতে পানির অভাব মিটাতে ৩৬৫টি পুকুর খনন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হাট-বাজার, মসজিদ-মন্দির ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ছাতিয়ানগ্রাম। এই গ্রামের জমিদারের নাম ছিলে আত্মারাম চৌধুরী। জমিদারের স্ত্রী ছিলেন শ্রী জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী (তমা দেবী)। তারা ছিলেন নিঃসন্তান। তবে সন্তান লাভের আশায় জমিদার তার বাড়ির অদূরে নির্জন এক পুকুর পাড়ে ঈশ্বরের সাধনা অর্চনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ১৭১৬ সালে তার স্ত্রীর গর্ভে ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখা হয় ভবানী।
জানা যায়, ভবানী শৈশব থেকে মানুষের সেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি ব্যতিক্রমভাবে তার বিয়ের আগেই ছাতিয়ান গ্রামের গরীব দুঃখী মানুষের কষ্ট নিবারণে এগিয়ে এসেছিলেন। ধর্ম চর্চার জন্য মসজিদ, মন্দির ও শিক্ষার জন্য এলাকায় নির্মাণ করেছিলেন স্কুল-মাদরাসা।
ভবানীর বয়স যখন ১০ বছর সে সময়ে ঘটে যায় এক দারুণ ঘটনা। একদিন নাটোর রাজবাড়ির দেওয়ান (মগনেহর) দয়ারাম নবাব আলীবর্দী খানের দরবার থেকে ফিরছিলেন। ফেরার পথে ছাতিয়ানগ্রামে রাত হয়ে গেলে, সেখানে তাঁবু ফেলা হয় রাতযাপনের জন্য। ভোরে তিনি তাঁবু থেকে বের হয়ে দেখলেন ফুটফুটে একটি মেয়ে লালশাড়ী পরে পূজার জন্য ফুল তুলছেন। রাজা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন মেয়েটি আত্মারাম চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে ভবানী।
দেওয়ান নাটোরের রাজকুমার রামকান্তের সঙ্গে ভবানীর বিয়ের প্রস্তাব দিলেন আত্মারামের কাছে। মতামত জানতে গেলে তিনটি শর্তে বিয়েতে রাজী হন ভবানী। তার প্রথম শর্ত ছিল বিয়ের পর এক বছর পিতার বাড়িতে থাকবেন। এক বছরে ছাতিয়ানগ্রামে প্রতিদিন একটি করে ৩৬৫টি পুকুর খনন করে দিতে হবে।
দ্বিতীয় শর্ত ছিল ছাতিয়ানগ্রাম থেকে নাটোর পর্যন্ত নতুন রাস্তা নির্মাণ করে পুরো রাস্তায় লাল সালুর কাপড় দিয়ে ছাউনি তৈরি করতে হবে। যার ভেতর দিয়ে ভবানী স্বামীর বাড়ি যাবেন। তৃতীয় শর্ত ছিল এলাকার প্রজাদের ভূমিদান করে তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
শর্ত অনুযায়ী এলাকায় পানির অভাব মিটাতে ৩৬৫টি পুকুর খনন করা হয়। পুকুরগুলোর সঙ্গে তার স্মৃতি ধরে রাখতে প্রতিদিন একটি করে পুকুরে গোসল করতেন ভবানী। ছাতিয়ানগ্রামে পুকুরগুলো আজও বিদ্যমান।
আদমদীঘির ছাতিয়ানগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বদিকের রাস্তাটির নাম ছিল ভবানীর জাঙ্গাল। সড়কটি ছাতিয়ানগ্রাম থেকে নাটোর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ থেকে প্রমাণ হয় রাজকুমার রামকান্ত সব শর্ত পূরণ করে ভবানীকে তার রানি করেছিলেন।
ছাতিয়ান গ্রামের বাসিন্দা ও জেলা বিএনপির সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মাহফুজুল হক টিকন জানান, রানি ভবানী তার বিয়ের শর্তে ৩৬৫টি পুকুর ও রাস্তাটি তার নিজের জন্য করেননি। করেছিলেন জনসাধারণের জন্য। সরকারি উদ্যোগে জমিদার বাড়িটি সংস্কার করা হলে ধ্বংস ও দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা পাবে।
ছাতিয়াগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সুদেব কুমার ঘোষ জানান, ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি রাজবাড়ি ও মন্দির ঝোপ-জঙ্গলে ভরা। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। এখন তার বাবার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ আছে মাত্র। তিনি সরকারি উদ্যোগে ভবানীর স্মৃতি রক্ষায় প্রাচীর নির্মাণের দাবি জানান।
স্থানীয়রা জানান, সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন ভেঙে গিয়ে জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। জমিদার বাড়িসহ আশপাশের জমি অবৈধভাবে দখল করা হচ্ছে। তবে, জমিদার বাড়িটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখনও শত শত মানুষ ভিড় জমায়।
বিডি-প্রতিদিন/এমই