একটি দেশে সুশাসন প্রবর্তন হওয়া ওই দেশের মানব সমাজের স্থিতি, শান্তি ও উন্নতির প্রধান ভিত্তি। আইনের শাসন, দায়িত্বশীল সরকার ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সুশাসন অতি জরুরি। দেশ ও সমাজের নেতৃত্বে ন্যায়, সততা ও জবাবদিহিতা অনুপস্থিত হলে কোনো সভ্যতাই টেকসই হতে পারে না। তাই ইসলাম সুশাসনকে কেবল রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবে নয়, বরং ধর্ম ও নৈতিকতার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সুশাসন হলো এমন এক নেতৃত্ব ব্যবস্থা, যা মানুষের ন্যায়নীতি রক্ষা করবে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে এবং সমাজকে নৈতিকতার পথে পরিচালিত করবে।
কোরআনে করিমের নির্দেশনা : কোরআনে করিমে সুশাসনের প্রতি স্বচ্ছ দিকনির্দেশনা দিয়েছে। কোরআন সুশাসনের প্রথম ও অপরিহার্য শর্ত হিসেবে আমানত রক্ষার কথা উল্লেখ করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার প্রকৃত অধিকারীর কাছে পৌঁছে দেবে এবং যখন মানুষের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে।’ (নিসা-৫৮)
এই আয়াত সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় ক্ষমতা, নেতৃত্ব, দায়িত্ব- সবই আমানত। ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত সম্পদ বা প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নেতৃত্বের মূল তত্ত্ব হলো ন্যায়বিচার। ব্যক্তি বিশেষ, দল বা গোষ্ঠী ন্যায় বিচারের মাধ্যম নয়। বরং ন্যায়বিচার হলো সমগ্র সমাজের অধিকার। অন্যত্র উল্লেখ আছে, ‘কোনো জাতির প্রতি নিজেদের বিদ্বেষ তোমাদের ন্যায়পরায়ণতা থেকে বিরত রাখবে না; ন্যায় কর, এটাই তাকওয়ার নিকটবর্তী।’ (মায়েদাহ-৮)
এ আয়াতে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সবক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার বাধ্যবাধকতা তুলে ধরে- যা সুশাসনের মৌলিক শর্ত।
হাদিসের নির্দেশনা : রসুলুল্লাহ (সা.) অগণিত হাদিসে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা ও সুশাসনভিত্তিক নেতৃত্বের গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন। বর্ণনা করেছেন এর যথার্থ মর্যাদা। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্ববান এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম) এ ঘোষণায় ইসলাম নেতৃত্বকে জবাবদিহির অঙ্গনে স্থাপন করেছে। নেতৃত্ব মানে প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতায়ন নয়; বরং আমানত রক্ষা এবং মানুষের হক আদায়ের দায়িত্ব। ন্যায়পরায়ণ নেতাদের মর্যাদা সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যারা ন্যায়ের সঙ্গে শাসন করে, আল্লাহর কাছে তারা নূরের মিম্বরে অবস্থান করবে।’ (সহিহ মুসলিম) হাদিসের এ বাণী প্রমাণ করে, ন্যায়ভিত্তিক সুশাসন দুনিয়ার শান্তি যেমন নিশ্চিত করে, তেমনি পরকালীন পুরস্কারের পথও উন্মুক্ত করে।
ইতিহাসে সুশাসনের বাস্তবতা : ইসলামি ইতিহাসে সুশাসনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনব্যবস্থা মানবসভ্যতার ইতিহাসে সুশাসনের অসাধারণ উদাহরণ। বিশেষত হজরত উমর (রা.)- যিনি তাঁর শাসনামলে ন্যায়, সত্য ও মানবিকতার সর্বোচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি- ‘যদি মরুভূমির পথে একটি কুকুরও ক্ষুধায় মারা যায়, আল্লাহ উমরের কাছেই জিজ্ঞাসা করবেন।’ এ বক্তব্য কোনো রাজনৈতিক নীতি নয়; বরং সুশাসনের গভীরতম মানবিক দর্শন। এ ছাড়া হজরত আলী (রা.) তাঁর প্রশাসনিক চিঠিতে গভীরভাবে উল্লেখ করেছেন নেতৃত্বের মূলে আছে দয়া, ন্যায় ও জনকল্যাণ। অত্যাচার নয়, পক্ষপাত নয়।
সুশাসনের অভাবে করুণ পরিণতি : যখন দেশ ও সমাজে ন্যায়বিচার বিলীন হয়, বিচারব্যবস্থা পক্ষপাতদুষ্ট হয় এবং নেতারা জবাবদিহি হারান, তখন সমাজে অস্থিরতা, অবিচার ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘সতর্ক হও- একটি বিপর্যয় এলে তা শুধু অত্যাচারীদেরই নয়; বরং সবাইকে গ্রাস করবে।’ (আনফাল-২৫) সমাজে অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে তার ক্ষতি সম্পূর্ণ জাতিকেই ভোগ করতে হয়- ইসলামের এ সতর্কবাণী আজও সত্য ও প্রযোজ্য। সুশাসনের ফল-সমৃদ্ধি, শান্তি ও নৈতিক উন্নতি। ইসলাম মানবসমাজকে ন্যায়ভিত্তিক সুশাসনের মাধ্যমে একত্র করে। এর ফলাফল তিনভাবে প্রকাশ পায়-
১. সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা : ন্যায়বিচার হলে মানুষ নিরাপদ বোধ করে, অপরাধ কমে, আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
২. রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি : গবেষণায় দেখা যায় যেসব দেশে নেতৃত্ব স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক, সেখানে অর্থনীতি দ্রুত উন্নত হয় এবং দুর্নীতি কমে।
৩. মানুষের নৈতিক উন্নতি : সুশাসন মানুষকে নৈতিকতার পথে পরিচালিত করে; অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে। ফলে সমাজে সহযোগিতা, দয়া, মানবিকতা ও ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পায়।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা
বিডি প্রতিদিন/এমআই