দুই দিনের ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে গিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রোটোকল ভেঙে উষ্ণ আলিঙ্গন, একই গাড়িতে সওয়ার হওয়া, নৈশভোজ, কাশ্মীরি জাফরান উপহার; খাতির-যত্নের কোনো ত্রুটি রাখেনি নরেন্দ্র মোদির সরকার। কিন্তু এই আতিথেয়তার ফল কতটা হাতে পেল নয়াদিল্লি, তা নিয়ে এখন জল্পনা তুঙ্গে। কারণ, এই সফরে মস্কোর সঙ্গে ভারতের বড় কোনো প্রতিরক্ষা বা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়নি, যা কূটনৈতিক মহলে বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত ৫ ডিসেম্বর হায়দরাবাদ হাউসে মোদির সঙ্গে পুতিনের শীর্ষ বৈঠক শেষে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ১৬টি চুক্তিতে সই করলেও কূটনৈতিক মহল বিষয়টিকে অত্যন্ত সাদামাটা বলেই মনে করছে। তাদের যুক্তি, এই সমঝোতাগুলি মূলত সচিব-আমলা পর্যায়েই অনায়াসে সম্পন্ন করা যেত। বিশেষ করে চীন, আমেরিকা বা পশ্চিমি বিশ্বের উদ্দেশে যৌথভাবে কোনো বলিষ্ঠ বার্তা দেননি দুই রাষ্ট্রনেতা। ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলএসিতে চীনের আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে নয়াদিল্লির উদ্বেগ থাকলেও মস্কোর নীরবতা মোদী সরকারের রক্তচাপ বাড়াল বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয় পারস্পরিক স্বার্থ এবং শক্তির সমীকরণের ভিত্তিতে, কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়নে নয়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বড় করে সামনে আনা হচ্ছে, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও করা হয়েছিল এবং এখন যার খেসারত দিতে হচ্ছে।
পুতিনের সফরের আগে এস-৪০০ বা এস-৫০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেলথ’ শ্রেণির যুদ্ধবিমান সু-৫৭ কেনার জল্পনা ছিল তুঙ্গে। কিন্তু বাস্তবে সেই ধরনের কোনো সামরিক সমঝোতা হয়নি, যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘চাপ’কেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে বৈঠক শেষে অপরিশোধিত খনিজ তেল নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করে দিল্লিকে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের আশ্বাস দিলেও, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রী পরে বুঝিয়ে দেন যে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে সস্তায় পাওয়া সত্ত্বেও মস্কোর থেকে ‘তরল সোনা’র আমদানি কমিয়ে দিয়েছে ভারত। সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার কারণে সামরিক চুক্তির বয়ান আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
কূটনৈতিক মহল মনে করে, এই সফরে চীন নিয়ে সাউথ ব্লকের উদ্বেগও সেভাবে জানাতে পারেনি নয়াদিল্লি। ফলে বেজিং-কাঁটা নিয়ে বর্তমান ভূকৌশলগত পরিস্থিতিতে রাশিয়া যে ভারতের পাশে দাঁড়াবে না, তা স্পষ্ট। ইউক্রেন যুদ্ধের খরচ চালাতে গিয়ে নিষেধাজ্ঞার নাগপাশে আবদ্ধ রাশিয়া এখন চীনের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল।
তবে পুরোপুরি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেও দেখতে নারাজ অনেকে। তাদের দাবি, অস্ত্রচুক্তির মতো সংবেদনশীল বিষয়ে অতীতেও রাশিয়া খুব বেশি ঢাক পেটায়নি, কিন্তু বন্ধুত্বের কর্তব্য পালন করে সময়মতো হাতিয়ার সরবরাহ করে এসেছে। এবারও যৌথ উৎপাদন সংক্রান্ত আলোচনা হয়েছে, তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে ডলারের বদলে রুপি-রুবল লেনদেনসহ অন্যান্য দিক বিবেচনা করতে হচ্ছে বলে সমঝোতা প্রক্রিয়া ধীর হয়েছে। সাবেক সেনাকর্তাদের মতে, সামরিক চুক্তি স্থগিত রাখায় আপাতত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘কাটসা’ নিষেধাজ্ঞা এড়ানো গেছে, যা মোদী সরকারের জন্য কূটনৈতিকভাবে লাভজনক।
অন্যদিকে, পুতিনের সফরে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ছোট আকারের মডিউলার রিয়্যাক্টরে রাশিয়ার লগ্নি এবং ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন বা ইএইইউ-র সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির বিষয়ে আলোচনা বেশ কিছু দূর এগিয়েছে। গত আর্থিক বছরে ভারত-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ৫,৮৯৩ কোটি ডলারের বিশাল ঘাটতি ছিল। রুপি-রুবল বাণিজ্যের মাধ্যমে এই ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে মোদি ঘোষণা করেছেন, দুই দেশের বাণিজ্য ১০ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া হবে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল