মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন সম্প্রতি পাকিস্তানের এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের জন্য ৬৮৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের উন্নত প্রযুক্তি এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহায়তার অনুমোদন দিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলতি বছরের মে মাসে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পাঁচ দিনের আকাশ যুদ্ধ হয়েছে। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র নয়াদিল্লিকে আরও অস্ত্র কেনার জন্য চাপ দিচ্ছে। ফলে সামরিক বিশ্লেষক ও কূটনীতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ওয়াশিংটনের এই পদক্ষেপ কি ভারতের প্রতি কোনো বার্তা বহন করছে?
চুক্তির নেপথ্যে কী?
এই চুক্তিটি পাকিস্তানের হাতে থাকা এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বহরের রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকায়নের জন্য ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া একটি বৃহত্তর চুক্তির অংশ। ব্রাসেলস-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রবীন ডোনথি আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, এফ-১৬ চুক্তিটি বিস্তৃত ইন্দো-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর লক্ষ্য হলো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বজায় রাখা। ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রশাসন পর্যন্ত এই নীতির ধারাবাহিকতা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা সহযোগিতা সংস্থা (ডিএসসিএ) গত ৪ ডিসেম্বর মার্কিন কংগ্রেসে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এই অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এই প্যাকেজে উন্নত ফ্লাইট পরিচালনা, ইলেকট্রনিক সিস্টেমের জন্য সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার আপডেট, শত্রুদের চিহ্নিত করার জন্য অ্যাডভান্সড আইডেন্টিফিকেশন ফ্রেন্ড অর ফো (আইএফএফ) সিস্টেম এবং ৯২টি লিংক-১৬ সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত। লিংক-১৬ হলো একটি সুরক্ষিত সামরিক ডেটা লিঙ্ক নেটওয়ার্ক, যা যুদ্ধবিমান, জাহাজ ও স্থলবাহিনীর মধ্যে রিয়েল-টাইম যোগাযোগ নিশ্চিত করে।
ডিএসসিএ অবশ্য ভারত সরকারের উদ্বেগ প্রশমিত করতে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই বিক্রি কার্যক্রম এই অঞ্চলে মৌলিক সামরিক ভারসাম্যকে পরিবর্তন করবে না। তবে ভারত দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সামরিক সহযোগিতার বিরোধিতা করে আসছে এবং অভিযোগ করেছে যে এই এফ-১৬ বিমানগুলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়।
ভারতের উপর চাপ
পাকিস্তানের জন্য এফ-১৬ আপগ্রেডের অনুমোদন এমন এক সময়ে এলো, যখন ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। গত আগস্টে, দিল্লি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র ও বিমান কেনার পরিকল্পনা স্থগিত করার পর ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফর বাতিল হয়।
এছাড়াও, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া থেকে কম দামে অপরিশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের আমদানি পণ্যের উপর বিদ্যমান ২৫ শতাংশ শুল্কের সাথে আরও ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করেছে। এই অর্থনৈতিক চাপও দুই দেশের সম্পর্কে সম্প্রতি উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে দীর্ঘমেয়াদী সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যেমন সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা বজায় রাখতে চাইছে, তেমনি অন্যদিকে ভারতের ওপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে যখন ভারতের প্রধান সামরিক সরবরাহকারী রাশিয়া এখনও ভারতের পাশে থাকার অঙ্গীকার করছে, তখন এই মার্কিন পদক্ষেপ দিল্লির কাছে ওয়াশিংটনের কৌশলগত অংশীদারিত্বের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।
তবে বিশ্লেষকরা এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পাকিস্তান তাদের অস্ত্রশস্ত্রের জন্য প্রধানত চীনের ওপর নির্ভরশীল। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে পাকিস্তানের ৮০ শতাংশেরও বেশি সামরিক সরঞ্জাম চীন সরবরাহ করেছে। মে মাসের সংঘাতেও তারা চীনের তৈরি জেএফ-১৭ এবং জে-১০ বিমান ব্যবহার করেছে। তাই এই আপগ্রেড পাকিস্তানকে তাদের এফ-১৬ বহর ২০৪০ সাল পর্যন্ত সচল রাখতে সাহায্য করলেও, সামগ্রিকভাবে চীনের সঙ্গে তাদের সামরিক নির্ভরতা অটুট থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
এই পুরো ঘটনাপ্রবাহ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলেছে, যেখানে ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হচ্ছে।
সূত্র: আল জাজিরা
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল