যুক্তরাষ্ট্রে পাল্টা শুল্ক এবং বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবসায় অনিশ্চয়তার কারণে চলতি বছর জুড়ে পোশাক রপ্তানিতে ধীরগতি দেখা দিলেও বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা আগামী বছরে শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের আশা প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে বড়দিনের বিক্রি শেষ হওয়ার পর জানুয়ারি থেকে মার্চ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পুনরায় নতুন ক্রয়াদেশ বাড়বে বলে তাদের প্রত্যাশা।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক বেড়ে ৩৬ শতাংশের বেশি : গত আগস্টে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। এর সঙ্গে আগের ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ শুল্ক যুক্ত হওয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে মোট ৩৬ দশমিক ১৫ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর আগে এপ্রিল মাসের হিসাবে সব আমদানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেই প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে এপ্রিল-আগস্ট সময়ে মার্কিন খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো শুল্ক সুবিধা নিয়ে আগাম বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে। এই আগাম মজুতকরণের ফলেই আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক পাঠানোর চাপ অনেক কমে যায়, যা বড়দিনের বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বড়দিনের পর ফের বাড়বে ক্রয়াদেশ : গার্মেন্টস রপ্তানিকারক জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক হাসান বলেন, বড়দিনের বিক্রি শেষ হলে মার্কিন বাজারে মজুত কমতে শুরু করবে। তখন জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে নতুন অর্ডার বাড়বে। মার্চের পর থেকে প্রবৃদ্ধি আরও দৃশ্যমান হবে। তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর সামগ্রিক বিক্রি প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাজারেও রপ্তানি মূল্যের চাপ রয়েছে। কারণ বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম একই বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় অনেক দেশ এখন ইইউর দিকে ঝুঁকছে, প্রতিযোগিতা আরও বাড়ছে, বলেন তিনি।
শুল্ক ধাক্কা কাটিয়ে ক্রয়াদেশ ফিরেছে : অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহির জানান, আলাপ-আলোচনার সময় শুল্ক পরিবর্তন নিয়ে ভোক্তা ও ব্র্যান্ডগুলোর সিদ্ধান্তে বিলম্ব হয়েছিল। তবে এখন বাজারে স্থিতি ফিরেছে। আমাদের কারখানাগুলো ইতোমধ্যেই ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত পূর্ণ সমতায় অর্ডার নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, পাল্টা শুল্কের প্রভাবে রপ্তানিতে ধীরগতি ছিল। ব্র্যান্ডগুলো অর্ডার দিতে সময় নিচ্ছিল। তবে এখন বাজার ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তিনি আরও জানান, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের আরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকা উচিত, যাতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হয়, বলেন তিনি। এক রপ্তানিকারক জানান, কম ক্রয়াদেশের কারণে বছরের প্রথমাংশে ব্যবসায়িক চাপ ছিল। তবে আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র শুল্কহার স্থির করার পর পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হচ্ছে। পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বড়দিনের চালান খুব শক্ত হয়নি। তবে বড়দিনের বিক্রি বাড়ার পর বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা আবার বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রপ্তানির সাম্প্রতিক চিত্র : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী জুলাই-অক্টোবর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। ২৫৮ কোটি মার্কিন ডলার। একই সময়ে ইউরোপে রপ্তানি বৃদ্ধি মাত্র শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি ৬২৫ কোটি ডলার। বিশ্লেষকদের মতে, এই সামান্য প্রবৃদ্ধিও মূল্যচাপ, শুল্কের অনিশ্চয়তা এবং আগাম মজুতকরণের মতো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাজার পরিস্থিতির তুলনায় ইতিবাচক।
আগামী বছরকে ঘিরে আশাবাদ : রপ্তানিকারকদের মতে, শুল্ক-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা কমেছে; বড়দিনের পর মার্কিন বাজারে মজুত কমে যাবে; মার্চ থেকে অর্ডার প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে; ইইউতে প্রতিযোগিতা বাড়লেও স্থিতিশীলতা আসছে; ২০২৬ পর্যন্ত অনেক কারখানাই নিশ্চিত ক্রয়াদেশ হাতে পেয়েছে। ফলে ২০২৬ সালের শুরু থেকে পোশাক রপ্তানিতে দৃশ্যমান পুনরুদ্ধার সম্ভব বলে তারা মনে করছেন।