মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের প্রেমের স্মৃতি তাজমহলকে ঘিরে হঠাৎ নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বলিউড পরিচালক তুষার গোয়েল নির্মিত দ্য তাজ স্টোরি সিনেমাটিই সেই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। সিনেমাটিতে বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত প্রেমের স্মৃতিস্তম্ভের সরকারিভাবে স্বীকৃত ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে, তাজমহল আসলে মুসলিম সমাধি নয়, বরং একটি হিন্দু প্রাসাদ যা পরে মুঘল শাসকেরা দখল করে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছিলেন। যদিও এই দাবির কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই এবং অতীতেও ইতিহাসবিদরা এমন তত্ত্বকে একাধিকবার খণ্ডন করেছেন।
সিনেমায় তাজমহলের ট্যুর গাইড চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশু দাস অর্থাৎ পরেশ রাওয়াল। সিনেমাটিতে তার মুখ দিয়ে বলা হয়েছে, এতদিন যেকোনো পর্যটককে তাজমহলের যে গল্প শোনানো হয়েছে, তা নাকি মিথ্যে হতে পারে এবং তাজমহলের ডিএনএ পরীক্ষা করা উচিত। দৃশ্যটি শেষ হয় এই সিদ্ধান্তে যে তারা ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বলিউডে এর আগে দ্য কাশ্মির ফাইলস এবং দ্য কেরালা স্টোরি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল এবং কয়েকটি রাজ্যে সিনেমা দুটো নিষিদ্ধও করা হয়।
সমালোচকদের অভিযোগ, দ্য তাজ স্টোরি সিনেমার উদ্দেশ্য ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিমকে হেয় করা এবং মুসলিমদের ইতিহাসকে বিকৃত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আধিপত্যপূর্ণ অতীত রচনার প্রচেষ্টা। তাদের দাবি, এসব চলচ্চিত্র ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির মতাদর্শের সঙ্গে মিলে যায়।
এই দলটির বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পরেশ রাওয়াল নিজেও বিজেপির সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন। যদিও পরিচালক তুষার গোয়েল দাবি করেছেন, সিনেমাটি কোনো রাজনৈতিক অর্থায়নে নির্মিত হয়নি।
ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের বহু গবেষণা বলছে, সিনেমাটির কাহিনি ইতিহাসসম্মত নয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সিনেমাটিকে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের কোলাজ বলে মন্তব্য করেছে। অন্যদিকে দ্য উইক লিখেছে, এটি না ভালো সিনেমা, না ঠিকঠাক প্রোপাগান্ডা। সিনেমাটি শুরু হয় দুই মিনিটের ডিসক্লেইমার দিয়ে যেখানে স্পষ্ট করা হয়েছে গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। যদিও পোস্টারে তাজমহলের ভেতর থেকে শিবের ছবি উঠে আসতে দেখা যায়, যা আরও বিতর্ক তৈরি করেছে।
১৩ লাখ ডলার বাজেটে নির্মিত সিনেমাটি বক্স অফিসে খুব বেশি সাড়া ফেলতে পারেনি এবং প্রায় ২০ লাখ ডলার আয় করেছে। তবে বিজেপির কিছু নেতার কাছ থেকে সিনেমাটি সমর্থন পেয়েছে। তারা বলছেন সত্য আর চাপা রাখা যাবে না। দর্শকদের একাংশও দাবি করেছেন তাদের এতদিন ভুল ইতিহাস শেখানো হয়েছে।
তাজমহলকে কেন্দ্র করে বিতর্ক অবশ্য নতুন নয়। ২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকারের একটি পর্যটন বুকলেটে তাজমহলকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। পরে বিজেপির এক রাজনীতিবিদ আদালতে আবেদন করেন তাজমহলের ভেতরের সিল করা ২২টি কক্ষ খুলে দেখতে। তিনি দাবি করেন সেখানে হিন্দু মন্দিরের প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। এই দাবি ছিল পিএন ওকের প্রচারিত ১৯৮০ দশকের তেজো মহালয়া তত্ত্বের পুনরাবৃত্তি, যার কোনো প্রমাণ নেই এবং যা প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ বহু বছরের গবেষণায় খণ্ডন করেছে।
সমালোচকদের মতে বলিউডে সাম্প্রতিক সময়ে ডানপন্থী রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট। তারা মনে করেন দ্য কাশ্মির ফাইলস ও দ্য কেরালা স্টোরির মতো সিনেমায় মুসলিমদের ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ইতিহাস বিকৃত করে উত্তেজনা ছড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে ডানপন্থী গোষ্ঠীরা হিন্দু ধর্মকে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে দাবি তুলে অন্নপূরাণী ও পদ্মাবতসহ একাধিক সিনেমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, ভারতের বহুত্ববাদী অতীতকে দুর্বল করার বড় প্রচারণার অংশ এই ধরনের সিনেমা। তাদের মতে অনেক মানুষের ইতিহাস জ্ঞান আসে সিনেমা দেখে, যেখানে কল্পকাহিনিকেই তারা সত্য মনে করে নেয়।
অথচ যমুনা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা মার্বেলের তাজমহল এখনো একই আছে, কিন্তু এর সাথে জুড়ে থাকা ইতিহাস ক্রমেই রাজনৈতিক তর্কে জড়িয়ে পড়ছে। সমালোচকদের মতে দ্য তাজ স্টোরি সেই বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/আশিক