ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একসময় বলেছিলেন, যারা হাওয়াই চপ্পল পরেন তারাও যেন একদিন হাওয়াই জাহাজ (বিমান) চড়তে পারেন। উদ্দেশ্য ছিল, দেশের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে বিমান যাত্রাকে সহজলভ্য করে তোলা। কিন্তু প্রতিযোগিতা কমে যাওয়া এবং অত্যধিক করের বোঝা সেই স্বপ্নকে কার্যত ধূলিসাৎ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শ্রীনগরে একটি কোচিং সেন্টার চালান সালমান শহীদ, শ্রীনগর থেকে নয়া দিল্লি পর্যন্ত ঘন ঘন যাতায়াত করতে হয়। তার পরিবারের সদস্যরা দিল্লিতে থাকেন। সময় বাঁচানোর জন্য বিমানই তার ভরসা। তবে এখন সেই ভরসায় আস্থা রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। শহীদ জানান, কোভিড-১৯ মহামারীর আগে শ্রীনগর থেকে দিল্লি পর্যন্ত একমুখী ফ্লাইটের গড় ভাড়া ছিল প্রায় ৩,৩০০ রুপি। এখন তা ৫ হাজার রুপিরও বেশি, ফ্লাইটের সময়সূচিও সীমিত। এই ৫০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি তার যাতায়াতের রুটিনে বড়সড় প্রভাব ফেলেছে। আগে মাসে অন্তত চারবার রাউন্ড-ট্রিপ করলেও এখন তিনি মাত্র দুবার যাতায়াত করেন।
শুধু সালমান শহীদ নন এই চিত্র এখন গোটা ভারতেই। গ্লোবাল ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন এসিআইর গত নভেম্বরের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে ভারতে অভ্যন্তরীণ বিমান ভাড়া বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক ভাড়াও বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এসিআই এবং ফ্লেয়ার এভিয়েশন কনসাল্টিংয়ের এই সমীক্ষায় বিমান ভাড়ার এই উল্লম্ফনের কারণ হিসেবে উচ্চ চাহিদা, কিছু রুটে সীমিত প্রতিযোগিতা এবং ২০১৯ সাল থেকে এভিয়েশন টারবাইন ফুয়েল (এটিএফ)-এর ৩৮ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়েছে।
অক্টোবর ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদী সরকারের চালু করা ‘উড়ে দেশ কা আম নাগরিক’ বা দেশের সাধারণ নাগরিকও উড়ুক প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য ছিল দেশের বিমান অবকাঠামো দ্রুত প্রসারিত করা এবং ছোট শহর ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আকাশপথের যাত্রাকে সহজলভ্য করা। মোদি নিজেই তখন বলেছিলেন, আমি চাই, যারা হাওয়াই চপ্পল পরেন, তারাও যেন হাওয়াই জাহাজ চড়েন। আজ ভাড়া লাগাতার বৃদ্ধি পাওয়ায় এই স্লোগানটি একটি ফাঁকা বুলি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন এভিয়েশন কার্গো ফেডারেশন অফ এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি ইন ইন্ডিয়ার চেয়ারপার্সন বন্দনা সিং।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমান ভাড়া বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রতিযোগিতার অভাব। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে একাধিক এয়ারলাইন বন্ধ হয়ে গেছে বা একীভূত হয়েছে। গো ফার্স্ট এবং জেট এয়ারওয়েজের মতো বড় সংস্থাগুলির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাজারে প্রতিযোগিতা কমেছে।
অন্যদিকে, টাটা গোষ্ঠীর হাতে এয়ার ইন্ডিয়ার সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ এবং পরে ভিস্তারা, এয়ারএশিয়া ইন্ডিয়ার মতো সংস্থাগুলির সঙ্গে এয়ার ইন্ডিয়ার একীভূতকরণ ভারতে বিমান শিল্পের রাশ মাত্র দুটি বেসরকারি খেলোয়াড়ের হাতে তুলে দিয়েছে। ফলস্বরূপ, এখন ইন্ডিগো এবং এয়ার ইন্ডিয়া যৌথভাবে ভারতের বিমান বাজারের প্রায় ৯১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
একাধিপত্যের এই প্রবণতার সুযোগ নিয়ে এয়ারলাইনগুলি সংকটকালীন সময়ে বা পিক সিজনে ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়াতে পারে বলে অভিযোগ রয়েছে। কাশ্মীর উপত্যকায় পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনার পর শ্রীনগর থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার একমুখী টিকিটের দাম ৫ হাজার রুপি থেকে প্রায় ১২ হাজার রুপিতে পৌঁছে গিয়েছিল। একইভাবে, কুম্ভ মেলার সময় মুম্বাই থেকে প্রয়াগরাজ পর্যন্ত একমুখী বিমান ভাড়া ৫০ হাজার রুপি পর্যন্ত হয়েছিল, যা প্যারিসের ফ্লাইটের চেয়েও বেশি দামি।
তবে বিমান ভাড়ার এই বাড়বাড়ন্তের জন্য শুধু বিমান সংস্থাগুলিই দায়ী নয়। ভারতের উচ্চ এভিয়েশন ট্যাক্সও একটি মূল কারণ। এশিয়া মহাদেশে এভিয়েশন টারবাইন ফুয়েল (এটিএফ)-এর ওপর ভারতেই সর্বোচ্চ কর চাপানো হয়। যা বিমান টিকিটের দামের প্রায় ৪৫ শতাংশের জন্য দায়ী। মধ্য-২০২৪ সাল নাগাদ দিল্লি ও মুম্বাইয়ের জেট ফুয়েলের দাম দুবাই, সিঙ্গাপুর বা কুয়ালালামপুরের মতো আন্তর্জাতিক হাবগুলির তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি ছিল, যার প্রধান কারণ রাজ্যগুলির ভ্যালু-অ্যাডেড ট্যাক্স এবং কেন্দ্রীয় আবগারি শুল্ক।
এছাড়াও, যাত্রীদের টিকিটের সঙ্গে ইউজার ডেভেলপমেন্ট ফি, প্যাসেঞ্জার সার্ভিস ফি, এভিয়েশন সিকিউরিটি ফি এবং রিজওনাল কানেকটিভিটি চার্জের মতো একাধিক ফি দিতে হয়, যাতে সামগ্রিকভাবে টিকিটের দাম বেড়ে যায়।
সূত্র: আল জাজিরা
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল