প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রূপ আর বৈচিত্র্য। কাপ্তাই হ্রদ, স্বচ্ছ জলধারা। অতিথি পাখির কলতান। আর ঝরনা। কী নেই পাহাড়ে। যার টানে ছুটে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা। আর এ ভ্রমণপিপাসুদের পুঁজি করে চাঙা হয়েছে পাহাড়ের পর্যটন ব্যবসা। ব্যস এটুকুতেই সন্তুষ্ট সবাই। কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না যে পাহাড়কে যত্ন না করলে হারিয়ে যাবে প্রকৃতির রূপের এ জৌলুস। যুগে যুগে তাই হয়েছে। পাহাড় এখন আগের মতো নেই। প্রাকৃতিকভাবে ভরপুর বৈচিত্র্য থাকলেও এ সম্ভাবনা যেন কাজেই লাগছে না! কারণ পাহাড়ের পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে নেই সঠিক কোনো পরিকল্পনা। যাদের পাহাড় আর সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলা দরকার, তাদের মধ্যেই নেই সমন্বয়হীনতা। বলছি পার্বত্য জেলা রাঙামাটির কথা। পাহাড় আর ঝরনার সমারোহে এ শহর গড়ে উঠেছে নিজস্ব স্বকীয়তায়। এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে যে কোনো ঋতুতেই ছুটে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি এ জেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। তাই বেড়াতে এসে হতাশ হচ্ছেন পর্যটকরা। তাদের মন ভরছে না।
পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে ঢেলে সাজানো গেলে এ অঞ্চলে দেশিবিদেশি পর্যটকদের যেমন আনাগোনা বাড়বে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে এলাকার মানুষ। সুবলং ঝরনা, ঘাগড়া কলাবাগ ঝরনা, পর্যটন কমপ্লেক্সের ঝুলন্ত সেতু, কাপ্তাই আসামবস্তি সড়ক ও ফুরামন পাহাড়ের মতো এমন অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে রাঙামাটিতে। এগুলোর অস্তিত্ব ধরে রাখতে হলে এখনই উদ্যোগ
নেওয়া প্রয়োজন।
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে প্রায় এক-দশমাংশ জায়গা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল গঠিত। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ও বৈচিত্র্যে ভরপুর রাঙামাটি। এর উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। পূর্বে মিজোরাম। এ ছাড়া পাশাপাশি পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। এখানে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ, দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র ও কর্ণফুলী পেপার মিল। এমন আরও অনেক প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সম্মিলনে রাঙামাটি জেলা গর্বিত। এ অঞ্চলে প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই রয়েছে নিজস্ব আচার অনুষ্ঠান, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যপূর্ণ সামাজিকতা। যার টানে কর্মব্যস্ততার ফাঁকে দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন রাঙামাটিতে।
সত্তর দশকের শেষ দিকে রাঙামাটি জেলাকে পর্যটন এলাকা ঘোষণা করে সরকার। এরপর পর্যটকদের সুবিধার্থে ১৯৭৮ সালে পর্যটন করপোরেশন মূল মোটেলটি এবং ১৯৮৬ সালে অডিটোরিয়াম ও দুটি পাহাড়ের সংযোগ দেওয়া কাপ্তাই হ্রদের ওপর ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করা হয়। সে সময় ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ মনোরম ঝুলন্ত সেতুটি পর্যটন কমপ্লেক্সের গুরুত্ব ও আকর্ষণ অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর একবারও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়নি পর্যটন ঝুলন্ত সেতু ও অডিটোরিয়ামটির। এখানে নেই শিশুদের জন্য খেলার স্পট। নামে পর্যটন এলাকা আকর্ষণ হলেও পর্যটকদের জন্য করা হয়নি সুব্যবস্থা। উন্নয়নের রেশমাত্র নেই। অযত্ন-অবহেলায় বিলীন হয়ে গেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। হাজার বছরের পুরোনো বৃক্ষ। তাই এখানে বেড়াতে আসা শুধু পর্যটকরা নন, হতাশ শীতের অতিথি পাখিরাও। তবু এর দায় নিতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা।
কর্তৃপক্ষের সাফাই রাঙামাটিতে অপার সম্ভাবনা থাকলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। রাঙামাটি পর্যটন জেলা পরিষদের হস্তান্তরিত বিভাগ হলেও পর্যটন বিষয়ে নেই তাদের কোনো আন্তরিকতা। তাদের সমন্বয়হীনতার অভাবে কোনো প্রস্তাবনাই বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
অন্যদিকে রাঙামাটি জেলা পরিষদে পর্যটন হস্তান্তর করা হলেও পুরোপুরি হস্তান্তর করা হয়নি বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্টরা এভাবে একে-অন্যের দিকে অভিযোগের তির ছুড়ছেন। প্রকৃত সমাধানে কারও আন্তরিকতা নেই। মাঝখান থেকে ধ্বংস হচ্ছে প্রাচীন বৃক্ষ, ঝরনা, জীববৈচিত্র্য। জৌলুস হারাচ্ছে পাহাড়। যা কিছুই মানা যায় না।
লেখক : সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রতিদিন