কলেজের প্রথমবর্ষ থেকেই ছেঁড়া জুতাগুলো ফেলত না জয়ন্ত। বলত, ‘জমিয়ে রাখছি। একদিন অসৎ মানুষদের গলায় ঝোলাব। যার যা প্রাপ্য তাকে সেটাই বুঝিয়ে দেওয়া উচিত।’ তার কথা শুনে হাসত সতীর্থরা। এত সহজ নাকি! দুর্বৃত্তদের খুঁটির জোর অনেক বেশি। হাসি দেখে রেগে যেত জয়ন্ত। বলত, ‘হাসছিস কেন! তোদের পরিত্যক্ত জুতাগুলোও জমিয়ে রাখ। আমার মতো কাজে লাগাতে পারবি। ফুলের মালা কি সবার সব সময় প্রাপ্য হয়!’ অন্যরা ইতস্তত করত। বলত, ‘না বাপু, আমাদের এত সাহস নেই! অত বিপ্লবী হয়ে আমাদের কাজ নেই। তুই চাইলে জুতার পাশাপাশি বাতিল ঝাড়ুও জমিয়ে রাখতে পারিস।’
জয়ন্তও শেষ পর্যন্ত সেই সাহস ধরে রাখতে পারেনি। পাস করে বেরিয়েই পেয়েছে কায়ক্লেশের সংসারের দায়িত্ব। তদ্দিনে বুঝে গেছে, বিপ্লবের কথাগুলো ময়দানের জনসভা ও বইয়ের পাতাতেই সুন্দর মানায়। বাস্তবে এর সামান্য প্রয়োগ নেই বললেই চলে। বরং একসময় যারা সমাজটাকে বদলে দিতে চাইত, তারা নিজেরাই ক্রমান্বয়ে পাল্টেছে। শামিল হয়েছে গড্ডলিকা প্রবাহে। উড়নচণ্ডী পরিচয় ঘুচিয়ে হচ্ছে চলতি হাওয়ার পন্থি। জয়ন্ত’র জমিয়ে রাখা জুতাগুলো ওই কাজে লাগেনি। তদ্দিনে বুঝে গিয়েছে, একার লড়াইয়ে পাহাড় টলানো সম্ভব নয়। নতুন জুতা কিনতে না পেরে বিপ্লবের জন্য জমানো জুতাগুলোকেই পুনর্র্নির্মাণ করেছে। জোড়া-তাপ্পি দিয়ে পরেছে। চাল-ডাল-তেল-আলুর বল্গাহীন ঊর্ধ্বগতিতেই হিমশিম খেতে হতো। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিছানায় পড়ে যাওয়া বাবার ওষুধ। দামি ওষুধ, তাও আবার খালি পেটে খাওয়ার সুযোগ নেই। পুষ্টিকর খাদ্য চাই। একদিকে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য, অন্যদিকে খেতচাষিদের হাহাকার। তারা ফসল ফলায় বটে, নিজেদের সন্তানের মুখে দিতে পারে কমই। ভরাতে হয় অন্যের উদর। ডান বাম মধ্য ও উগ্রপন্থার নেতারা যার যার অবস্থান থেকে বক্তব্য দেন। ভুখা-নাঙ্গা মানুষের সামনে ঝুলিয়ে রাখেন রঙিন স্বপ্নের ঝালর। রঙের ও রঙ্গের বাতি। তাতে কোথাও কিচ্ছুটি পাল্টায় না।
জয়ন্ত অনুভব করে, পেট বাঁচাতে হলে আগে পা বাঁচাতে হবে। এ দুটোকে বাঁচাতে পারলে জীবন বাঁচবে। সমস্যা হচ্ছে, একটিকে প্রাধান্য দিলে অন্যটি পিছিয়ে পড়ে। পুরোনো জুতাগুলোর স্টক শেষ। শেষ জুতাটি পরছে বর্তমানে। গোড়ালির দিকে মাঝখানে কাটা আধুলির রূপ ধারণ করেছে জুতা। দুই পাটিরই একই অবস্থা। পায়ের পাতার একাংশ ধুলো-বালির সাক্ষাৎ পায় বটে, তাতে বড় কোনো সমস্যা হয় না। বাসায় ফিরে চাপকলে পা-জোড়া ভালোভাবে ধুয়ে নিলেই হয়। ময়লা খতম! বিপরীতে মনের ময়লা, জমানো ক্লেদ কোথাও যায় না। দিনদিন জমাট বেঁধে গাঢ় অন্ধকারে রূপ নিচ্ছে। অভিজাত কিছু বাসা ও অফিস আছে, যেগুলোতে জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়। এসব পরিস্থিতিতে ভিতরে ভিতরে কেন্নোর মতো গুটিয়ে গেলেও কিছুই করার থাকে না। তড়িঘড়ি করে কাজ সেরে বেরোতে পারলেই বাঁচে। এই ফুটো জুতা কেউ দেখলে, মালিক হিসেবে যদি জয়ন্ত চিহ্নিত হয়ে যায়- নিজের মেকি ভদ্রলোক পরিচয়টা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। এর চেয়ে ভালো রাস্তার নুলো ভিখারি। তাকে সামাজিকতা ও লৌকিকতার পরোয়া করতে হয় না। ভদ্রলোকের মুখোশও সাঁটাতে হয় না শরীরের কোথাও।
অনেক দিনের আশঙ্কাটা বাস্তবে ফলে গেল আজ! বেরিয়ে এলো ভদ্র-ভিখারির তলানির হদিস। মঞ্জু ভাই কয়েক দিন যাবৎ বাসায় যেতে বলছেন। নিশ্চয়ই কোনো জরুরি দরকার, না হলে এত তাড়া দিতেন না। অফিসের কাজ শেষে সন্ধ্যায় তার বাসায় গেল জয়ন্ত। মঞ্জু ভাই সহাস্যে বললেন, ‘কফির নতুন বয়াম কিনেছি। ভাবলাম তোমাকে নিয়েই উদ্বোধন করি। তাই বারবার মূল্যবান সময় প্রার্থনা!’ জয়ন্ত স্মিত হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘কী যে বলেন! আপনি কোনো কারণ ছাড়া ডাকলেও কি আমি আসতাম না?’ ‘তা আসতে বটে। এদিকে আমার ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিতে হতো। পৃথিবীর ব্যস্ততম মানুষের শিডিউল পাওয়া অত সহজ নয়।’ কফি, চানাচুর, বিস্কুট সহযোগে আড্ডা চলল প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে। অসাম্য ও মুক্তবাজার অর্থনীতির দফারফা হলো বার-কয়েক! বিদায়ের সময় মঞ্জু ভাই এগিয়ে দিতে এলেন দরজা পর্যন্ত। বারান্দায় রাখা জয়ন্তর জুতার অবস্থা দেখে তার ভ্রু পৌঁছে গেল মাঝ কপাল বরাবর। চটজলদি জয়ন্ত’র জুতা জোড়া ভিতরে নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। নিয়ে এলেন চৌকোনা একটি কাগজের বাক্স। জয়ন্ত’র হাতে সেটা তুলে দিয়ে মঞ্জু ভাই বললেন, ‘প্রকৃতপক্ষে তোমাকে এটা দেওয়াই ছিল আমার উদ্দেশ্য।’
নিজের জুতা যেহেতু বেহাত হয়েছে, জোর আপত্তি জানিয়েও লাভ হবে না। মঞ্জু ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাস্তায় নামল জয়ন্ত। এই ঝা-চকচকে জুতাতেও নিজেকে কেমন যেন পরাজিত সৈনিক মনে হচ্ছে। জুতাগুলো এমন কেন, নিজের জুতায় এক রকম অনুভূতি, অন্যের জুতায় আরেক রকম। অস্বস্তি কাটে না।
কয়েক বছর যাবৎ অফিসে অন্যায়ভাবে আটকে আছে জয়ন্ত’র প্রাপ্য ইনক্রিমেন্ট প্রমোশন। বড় সাহেবের জুতায় ওর হাত, পায়ের তালু অবধি জিহ্বা পড়েনি বলেই হয়তো এমন দুর্গতি। সিদ্ধান্ত নেয় জয়ন্ত, আগামীকাল এই জুতা পায়ে দিয়ে বসের রুমে যাবে। তারপর জুতাটা নিজের গালেই মারবে বড় কর্তাকে সাক্ষী রেখো। এত দামি জুতার ব্যবহার অপাত্রে করা উচিত হবে না! পরক্ষণে সিদ্ধান্তটা বদলায় জয়ন্ত। মঞ্জু ভাইয়ের বাসা থেকে বাতিল জুতাটা নিয়ে এলেই তো হয়! তাতে অন্তত ওই জুতার সদগতি হবে। যা সে সেই প্রথম যৌবনে ভাবতো। এই ভাবনা থেকে মঞ্জু ভাইকে কল দিল সে। বলল- ‘ভাই, আমার জুতাজোড়া ফেলবেন না যেন। আজ বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। কাল ওটা আমি ফেরত নিতে আসব।’
বিরক্ত মঞ্জু ভাই কঠিন কথাটা এবার না বলে পারলেন না - ‘বুঝলে জয়ন্ত, নজর সব সময় নিচু করে রাখলে দিন পাল্টাবে কীভাবে! বিপ্লব কি অত সহজ বস্তু? মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখো। এই নতুন জুতো পরেই কাল অফিসে যাবে। তারপর যা করার করবে।’ লাইন কেটে দিলেন মঞ্জু ভাই।
জয়ন্ত একটা কথাও বলেনি। শুধু শুনে গেছে। এর মধ্যে ওর নুয়ে আসা মেরুদণ্ডটা নিজে থেকেই কেমন যেন টানটান হয়ে যায়। পরদিন এখনকার সবচেয়ে ভালো পোশাকটা পরে, নতুন জুতা পায়ে দিয়ে অফিসে গেল জয়ন্ত।
নিজের ডেস্কে ব্যাগটা রেখে, নতুন জুতার মচ মচ শব্দ ছড়িয়ে, পূর্ব অনুমতি না নিয়েই, নক না করেই গট গট করে ঢুকে গেল বসের কেবিনে। বিরক্ত, ক্রুদ্ধ চোখে তাকালেন তিনি। জয়ন্ত ভ্রুক্ষেপ করল না। একটু নিচু হয়ে ডান পায়ের জুতাটা খুলে বসের মুখের সামনে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাল। বলল- ‘যৌবনে আমাদের বিপ্লবী দলের নেতা মঞ্জু ভাই গতকাল এটা দিয়েছেন। আজ একটা শঙ্খ মাছের লেজের চাবুক দেবেন। বলেছেন, যথাস্থানে এগুলো যথাযথ ব্যবহার করতে। এ আদেশ আমার জন্য শিরোধার্য। কাল থেকেই তার প্রয়োগ শুরু হবে’।
বলেই জয়ন্ত ঘুরে দাঁড়াল। পেছনে হতবিহবল, ঘটনার আকস্মিকতায় খানিকটা বিপর্যস্ত বসের দিকে একবার ফিরেও না তাকিয়ে সুইং ডোর ঠেলে বেরিয়ে এলো জয়ন্ত। তার হারানো দৃঢ়-দৃপ্ত পদক্ষেপে মচমচ, খট খট শব্দ ছড়িয়ে পড়ল পুরো ফ্লোরে...