বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে মেঘলা অববাহিকার জেলা নোয়াখালী। এর আয়তন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। দক্ষিণে আরও নতুন নতুন চর জাগায় এর আয়তন ক্রমে বাড়ছে। একসময় পিছিয়ে থাকলেও পরিশ্রম, মেধা ও উদ্যম কাজে লাগিয়ে দেশ-বিদেশে নোয়াখালীবাসী নিজেদের অবস্থান সমুন্নত করেছে। এ ভূখণ্ডের মানুষ অত্যন্ত পরিশ্রমী, সাহসী ও সংগ্রামী। এখন বলা হয় দেশের শীর্ষ ধনী জেলা নোয়াখালী। এ জেলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও পিছিয়ে নেই। মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি আবদুল হাকিম নোয়াখালীর সন্তান। ‘নূরনামা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য অধিক পরিচিত। তাঁর ছিল ফারসি, আরবি ও সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য। সপ্তদশ শতকের বাংলা সাহিত্যের সেরা কবিদের অন্যতম কবি আবদুল হাকিম। নোয়াখালী জেলার বাবুপুর গ্রামে ১৬৬০ সালে তাঁর জন্ম। আবদুল হাকিমের কবিতায় স্পষ্ট-নোয়াখালীর মানুষ নিজ দেশ, ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কত ভালোবাসে। ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুরায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।’
চৌধুরীর লড়াই এ জেলার বিখ্যাত পালাগান। এ জেলার কবি আব্দুল বারীকে ‘কবিরত্ন’ খেতাব দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। পঞ্চাশ দশকের বিখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু, কবি ও গীতিকার গোপাল হালদারের অবদান সবার জানা। সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে এমন কিছু বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হলেন-শহীদ বুদ্ধিজীবী মোজাম্মেল হায়দার চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, প্যারীমোহন সেন, অনঙ্গ মোহন দাস, অশ্বিনী কুমার সোম, এ কে এম খায়রুল বাসার, খালেদ মাসুকে রসূল, শাহ জাহান কিবরিয়া, কবি ও নয়া কৃষি আন্দোলনের প্রবর্তক ফরহাদ মজহার, আব্দুর রশিদ ওয়াসেকপুরী, অধ্যাপক মো. ফজলি হোসেন প্রমুখ। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য অধ্যক্ষ টি হোসেন,-‘স্মৃতিকণা’ নামে অনন্য এক গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। এ জেলার উল্লেখযোগ্য লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক আব্দুল জলিল, আবদুল মতিন, আতাউর রহমান, মাহমুদুল হক ফয়েজ, মো. সিরাজুল হক, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, কামাল উদ্দিন ভাষাসৈনিক, সিরাজুল ইসলাম মুনির, জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক আবু তাহের প্রমুখ।
শহীদ মুনীর চৌধুরীর অগ্রজ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক। বাংলা একাডেমি ও একুশে পদকে ভূষিত লেখক। দেশের অনুবাদ সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। লিখেছেন আড়াই শতাধিক বই। আবদুশ শাকুর কথাশিল্পী, গল্পকার, সংগীতজ্ঞ। বহু ভাষায় পারদর্শী, নিসর্গপ্রেমী। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। প্রণব ভট্ট নোয়াখালীর বিশিষ্ট কথাশিল্পী ও নাট্যকার ছিলেন। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় নাটক রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। ফখরুল ইসলাম প্রাবন্ধিক নোয়াখালীর আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে কয়েকটি বই সম্পাদনা করেছেন। ড. খালেদ মাসুকে রসূল। লোকসংস্কৃতি গবেষক। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত তাঁর ‘নোয়াখালীর লোকসংস্কৃতি’ শীর্ষক প্রামাণ্য গ্রন্থ। তাঁর মেয়ে-লায়লা কাউকাইন আরাও লেখালেখি করেন। কে জি মোস্তফা ছিলেন প্রখ্যাত গীতিকার, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। কে জি মোস্তফার বাড়ি সোনাইমুড়ী উপজেলায়। পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। জনপ্রিয় গান ‘রাজধানীর বুকে’ ছায়াছবির ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে’, লিখে সত্তরের দশকে সাড়া ফেলে দিলেন কে জি মোস্তফা। এতে কণ্ঠ দেন তালাত মাহমুদ। ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ এ রকম অনেক কালজয়ী গানের রচয়িতা কে জি মোস্তফা।
চিত্তরঞ্জন সাহা প্রকাশক, সংস্কৃতি সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য ও প্রকাশনার তীর্থস্থান হয়ে ওঠে নোয়াখালীর চৌমুহনী। চিত্তরঞ্জন সাহার উদ্যোগে ‘পুঁথিঘর’ প্রকাশনা সংস্থা পরবর্তীতে ‘মুক্তধারা’ দেশের সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশনার বাতিঘরে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশের বইমেলার শুভ সূচনা হয় চিত্তরঞ্জন সাহার উদ্যোগে। একাডেমির বটতলায় চট বিছিয়ে বই সাজিয়ে বিক্রির মাধ্যমে তিনি শুরু করেন বইমেলা। এই মেলা আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বইমেলায় রূপান্তরিত। চিত্তরঞ্জন সাহা একুশে পদক লাভ করেন ২০০৫ সালে। মারা গেছেন ২০০৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর।
আঞ্চলিক গানের বিস্ময়কর প্রতিভা ছিলেন মোহাম্মদ হাশেম। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী। ‘আংগো বাড়ি নোয়াখালী রয়েল ডিস্ট্রিক ভাই, হেনী মাইজদী চৌমুহনীর নামটি হুনেন নাই’ কিংবা ‘দুবাই গেছে আংগো বাড়ির মোহাম্মদ আলী-হেতার লাই কাঁদে হেতার হালা হালি।’ এমন ৩ হাজারেরও বেশি গান তাঁর লেখা ও সুর করা। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শাহনাজ হাশেম কাজল বাবার মতোই সংগীতপ্রেমী। নোয়াখালীর আঞ্চলিক গানের চর্চা তিনি ধরে রেখেছেন। মামুনুর রশীদ কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মী। তাঁর দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। আখতার জাহান শেলী লেখালেখিতে নিমগ্ন বহু বছর ধরে। ইতোমধ্যে কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। শিরীণ আক্তার মূলত কবি, কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। সূফী সৈয়দ রূপক রশীদ কবি, সম্পাদক ও প্রকাশক। বদরুল হায়দার মূলত কবি। সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত তিন দশক ধরে। বেশ কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। জামাল হোসেন বিষাদ কবি ও সাংবাদিক। মশিউর রহমান মসী কবি, সংগঠক ও সংস্কৃতিকর্মী। শফিক হাসান কবি, গল্পকার, রম্যলেখক, ভ্রমণকাহিনি রচয়িতা। লেখালেখিতে তুমুল সরব ধীমান এ লেখকের বেশ কয়েকটি বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কবি, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী সারওয়ার ই আলম। প্রবাসে থাকলেও সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
২০২২ সালে নোয়াখালীর ২০০ বছরপূর্তি উদযাপন করা হয়। এ উৎসবের মূল আয়োজক সংস্কৃতিজন ও উন্নয়ন সংগঠক আবদুল আউয়াল। দুই দিনের বর্ণাঢ্য এ উৎসবে কবি, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিজনসহ বিপুলসংখক মানুষ অংশ নেন। উৎসবে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য যাঁদের সম্মাননা দেওয়া হয় তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক আবু তাহের, কবি আখতার জাহান শেলী, লেখক ফখরুল ইসলাম, কবি গোলাম আকবর, কবি শিরিন আখতার। ২০২৪ সালের মে মাসে বৃহত্তর নোয়াখালীর কবিদের নিয়ে দুই দিনব্যাপী কবিতা উৎসব হয়। উৎসবে ঢাকা, কলকাতা ও আসামের কবিরাও অংশ নেন। তিন শতাধিক কবি এ উৎসবে যোগ দেন। এ উৎসব প্রমাণ করে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি নোয়াখালীবাসীর অনুরাগ ভালোবাসা কত গভীর।
নারী লেখক : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর পঙ্ক্তি- বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। নোয়াখালীর নারী কবি লেখকের সংখ্যা কম নয়। আখতার জাহান শেলী, শিরিন আখতার, রওশন জাহান, জোবাইদা নাসরিন, রহিমা আখতার মৌ, নুসরাত রুমু, মৌ মধুবন্তী, রায়হানা হোসেন, আখতারুন নাহার আলো, রোকসানা আক্তার ছায়াময়ী, আলেয়া ফেরদৌসী, রেজিনা সুলতানা, নাদিরা কিরণ, লায়লা কাউকাইন আরা, সুমনা চৌধুরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
২০২৪ সালের মে মাসে দুই দিন ধরে উদ্যাপিত ‘নোয়াখালী কবিতা উৎসবে’ নিবন্ধিত হন দুই শ কবি। এদের সবাইকে উত্তীর্ণ কবি তা বলা যাবে না। তবে এরা কবিতা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কবিতা ভালোবাসেন। এদের ভিতরেই একজন ফকির লালন, শাহ আব্দুল করিম, শামসুর রাহমান, কিংবা হুমায়ুন আজাদ লুকিয়ে আছেন কিনা-সময়ই তা বলে দেবে। বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি, লেখক : স্বপন দেলওয়ার, মিরন মহিউদ্দিন, আবুল বাসার, গোলাম আকবর, সূফী সৈয়দ রূপক রশীদ, বদরুল হায়দার, মিন্টু সারেং, কাজী খসরু, মামুনুর রশীদ, লিয়াকত বখতিয়ার, আনোয়ার কবির, সাজ্জাদ রাহমান, সারওয়ার ই আলম, চঞ্চল আক্তার, আজাদ আলাউদ্দিন, আ কা আজাদ, ওয়ালী জসীম, অভিলাষ দাশ, জামাল হোসেন বিষাদ, হানিফ মজুমদার, সোলায়মান সহজ, হাবীব ইমন, সিরাজুল ইসলাম মুকুল, মোস্তফা ইকবাল, শফিক হাসান, মাসুম রেজা তরু, মশিউর রহমান মসী, মশিউর রহমান মিঠু, ফারুক মোজাম্মেল, ফরিদ উদ্দিন মনু, আলমগীর হোসেন, ফারুক আল ফয়সাল, নজির আহমেদ, মহিউদ্দিন চৌধুরী মোহন, আলাউদ্দিন সুজন, ফিরোজ মাল, প্রদীপ নারায়ণ সাহা, ফিরোজ শাহ প্রমুখ। এসব কবি-লেখকের কারও কারও এক বা একাধিক বই বের হয়েছে। কারও কারও অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যে তাঁরা কে কত দূর যাবেন, সাহিত্যে কতটা অবদান রাখবেন তা সময়ই বলে দেবে।
সাহিত্য পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিন : নোয়াখালীর সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে প্রণোদিত করতে সাহিত্যসেবীদের উদ্যোগে নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে বেশ কিছু সাহিত্য পত্রিকা এবং লিটলম্যাগ প্রকাশ হচ্ছে; যা আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছে। ‘সুবর্ণরেখা’, ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, সম্পাদনা : মিরন মহিউদ্দিন। কবিতা চর্চা সম্পাদনা : বদরুল হায়দার। ‘গদ্য’, ‘সম্পর্ক’, সম্পাদনায় : এ নিবন্ধকার। ‘একদা অজপাড়াগাঁয়ে জ্যোৎস্না’, সম্পাদনা : জামাল হোসেন বিষাদ। ‘মেঠোপথ’, সম্পাদনা : নুরুল হক। ‘বিজয়’, সম্পাদনা : নোয়াখালী বিজয় মেলা উদ্যাপন পরিষদ। ‘নোঙ্গর’, সম্পাদনা : সুমন নূর। ‘স্পর্ধা সব সময়’, সম্পাদনা : হাবীব ইমন। ‘লেখক’, সম্পাদনা : কামাল মাসুদ। ‘প্রাঙ্গণ’, সম্পাদনা : সুবল দেবনাথ। ‘ভুলুয়া’, ‘মহেন্দ্র উপকূল’, সম্পাদনা : সৈয়দ মো. হারুনূর রশীদ। ‘সুরঞ্জনা’, সম্পাদনা : ম. পানা উল্লাহ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ভাষা ও সংস্কৃতি : আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-ভৌগোলিক বহুবিধ অনুষঙ্গের কারণে অঞ্চলভেদে সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। ফলত একটি দেশের সামগ্রিক লোকসংস্কৃতি এবং একটি বিশেষ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিতেও অনেক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই নোয়াখালী জেলার লোকসংস্কৃতিতে তার একটি পরিচ্ছন্ন ছাপ পরিলক্ষিত হয়। বহু ভাঙা-গড়া, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধ জনপদ নোয়াখালী। এ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির প্রতি একটু ঘনিষ্ঠ হলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এ অঞ্চলের একটি সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতির পরিমণ্ডল রয়েছে। লোকসংস্কৃতির প্রধানতম শাখা লোকসাহিত্য। নোয়াখালীর লোকসাহিত্য এ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ এবং জীবনঘনিষ্ঠ তা এ অঞ্চলের প্রবাদ-প্রবচন, আঞ্চলিক গান, ধাঁধা, ছড়া থেকে সহজেই অনুমেয়।
কিছু প্রবচন : ‘মাইনষের কুডুম আইলে গেলে, গরুর কুডুম লেইলে হুঁইছলে’-এ প্রবচনটি গূঢ়ার্থ হলো মানুষের কুটুম্বিতা তথা আতিথেয়তা বোঝা যায় পরস্পরের আসা-যাওয়ার মাধ্যমে, আর গরুর তা বোঝা যায় লেহনের মাধ্যমে। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যে ঐতিহ্যগতভাবেই আত্মীয় বৎসল প্রবচনটি সেটাই ইঙ্গিত করে। “ঝি থাইকলে জামাইর আদর, ধান থাইকলে উডানের আদর”-এ প্রবচনটির সরল অর্থ হচ্ছে কন্যার কারণেই মানুষ জামাতাকে খাতির করে, আর ধান প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রয়োজনে উঠানের যত্ন করে। কিন্তু এসব প্রবচনের মূলে যে সূক্ষ্ম দার্শনিক কার্যকারণ রয়েছে, তা কি আমরা ভেবে দেখার অবকাশ পাই? “মাছ ধোঅন হিঁড়া, গোস্ত দোঅন মিড়া”-এ প্রবচনের মধ্য দিয়ে নবীন কোনো রাঁধুনিকে শেখানোর চেষ্টা করা হয় যে, রান্নার আগে মাছটা খুব ভালোভাবে ধুতে হয় এবং মাংসটা অপেক্ষাকৃত কম ধুলেও চলবে। সাধারণ গার্হস্থ্য শিক্ষা ছাড়াও এ প্রবচন এটাই প্রমাণ করে যে, এ অঞ্চলের মানুষ সুদীর্ঘ সময় ধরেই মাছ, মাংস খেয়ে অভ্যস্ত। এরকম “উডান ঠন ঠন হিঁড়াত বাড়ী, ধলা হিরিসতার হোন্দে দাঁড়ি”। “কেরে ভাই চৈতি রাঙ্গা, গাছের আগাতহৈল হো’না”। “বনের তোন্ বার অইল ভুতি, ভাত বেড়াই দিল মুতি” ধাঁধার উত্তর যথাক্রমে- রসুন, খেজুর, লেবু।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ : মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জাতীয় সাত বীরশ্রেষ্ঠের একজন নোয়াখালী সোনাইমুড়ীর। তিনি বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিন। তাঁর নামে তাঁর গ্রামে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর হয়েছে ২০০৮ সালে। নোয়াখালী জেলা সদর থেকে ২৫ কিমি. উত্তর এবং সোনাইমুড়ী উপজেলার সদর থেকে ৮ কিমি. পশ্চিমে দেওটি ইউনিয়নভুক্ত বর্তমান রুহুল আমিন নগর (বাগপাচরা) গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিনের পৈতৃক ভূমিতে নির্মাণ করা হয় এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিনের পরিবারের সদস্যদের দেওয়া জমিতে নির্মাণ করা হয় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। একটি সুপরিসর এবং সুসজ্জিত পাঠকক্ষ ছাড়াও এখানে রয়েছে অভ্যর্থনা কক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক ও লাইব্রেরিয়ানের জন্য আলাদা কক্ষ।
গান্ধী আশ্রম জাদুঘর : নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীকোর্ট থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগ বাজারের কাছে অবস্থিত মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত আশ্রম ও জাদুঘর। প্রয়াত জমিদার ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষের বাড়িতে স্থাপিত গান্ধী আশ্রম নোয়াখালীর একটি সেবামূলক সংগঠন হিসেবে সারা দেশে সুনাম অর্জন করেছে। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস সমাজব্যবস্থার ধারণাকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে ২০০০ সালের ২ অক্টোবর গান্ধী আশ্রমের মূল ভবনে গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর যাত্রা শুরু করে। এখানে রাখা গান্ধীর বিভিন্ন দুর্লভ ছবি, বই, ব্যবহার্য জিনিস এবং তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন যে কারও মনোজগৎ নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ভারতে ১৯৪৬ সালের শেষের দিকে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িকতার বিষ নোয়াখালীকেও স্পর্শ করে। তখন শান্তি মিশন নিয়ে নোয়াখালী এলেন অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী। তিনি ১৯৪৬-এর ৭ নভেম্বর নোয়াখালীর চৌমুহনী রেলস্টেশনে পদার্পণ করেন। সাম্প্রদায়িক মনোভাব দূর করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে করতে জয়াগ গ্রামে পৌঁছেন ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি। আর সেদিন নোয়াখালী জেলার প্রথম ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষ তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গান্ধীজির আদর্শ প্রচার ও স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আম্বিকা কালিগঙ্গা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এবং গান্ধী আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালে ট্রাস্টের নামকরণ হয় ‘গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’।