“হঠাৎ তার ঘরে ঢুকে দেখলাম একটা সাবানের বাক্সে নানা রঙের ‘রিবন’ রয়েছে। পাশেই আর একটা কৌটো, ঢাকনাটা প্লাস্টিকের, তার ভেতর নানা রকম পুঁতি। শেলফের উপরেই তিনটে মোটা খাতা, এক্সারসাইজ বুক। খুলে দেখলাম প্রত্যেকটি ছবিতে ভরা। একটাতে ওয়ালট ডিসনের আঁকা ট্রু লাইফ অ্যাডভেঞ্চারস। আর একটাতে প্রজাপতি আর পাখির রঙিন ছবি। কয়েকটা কুকুরেরও। সব সুন্দর ছবি। তৃতীয়টাতে ডাকটিকিট।... ক্যালেন্ডার ঝুলছে এপাশ-ওপাশ। একটাতে ক্রন্দনোন্মুক একটি নাদুসনুদুস ছেলের ছবি, আর একটাতে তাজমহলের। বাঁ দিকের শেলফে নিপুণভাবে গোছানো বইয়ের সারি। অধিকাংশই কলেজের বই, কিন্তু ‘সঞ্চয়িতা’ এবং ‘গীতবিতান’ও আছে। শেলফের পাশেই নীল টেবিলটা; আর তার উপরে তার শৌখিন টেবিল ল্যাম্পটা। সেকালে মফস্বলের মিউনিসিপালিটি রাস্তায় যে ধরনের আলো দিত, ল্যাম্পটাও সেই রকম। দেয়ালে আর একটি ল্যাম্প। তার কাগজের শেভে চমৎকার ফুল কাটা, অনেকটা রঙিন আলপনার মতো। বিছানার ধারে ধবধবে সাদা বেড সুইচটি ঝুলছে। শৌখিন বেডকভার ঢাকা ছোট্ট বিছানাটি পাতাই রয়েছে। এর পাশেই একটা ছোট শেলফ। তাতে ছোট্ট টাইমপিসটি রয়েছে, বন্ধ হয়ে রয়েছে, দম দেওয়া হয়নি বলে। ঘড়ি ছাড়া টুকিটাকি আরও কত জিনিস। অদ্ভুত আকৃতির বেঁটে সুন্দর একটা আতরের শিশি। তা ছাড়া মাথার কাঁটা, চুলের ফিতে, ছোট ছোট ঝিনুক দিয়ে তৈরি ফুলের মতো একটি পেপারওয়েট। আর একটা পেপারওয়েট ডিম্বাকৃতি কাচের, গাঢ় বাদামি রঙের।
আলমারিতে পুতুলের সমারোহ। কেষ্ট নগরের লক্ষ্মী-সরস্বতী-মহাদেব। বৈদিক ধাঁচের দাঁড়ানো সরস্বতীও রয়েছে একটি। তা ছাড়া ব্রোঞ্জের মতো দেখতে, আর একটা কলসি কাঁখে তন্বী তরুণী। শান্তিনিকেতনের পুতুল কৃষক-দম্পতি। স্ত্রীর মাথায় ঝুড়ি, পুরুষের কাঁধে শিশুপুত্র। তার এপাশে একটি বক, আর এক-পাশে রবীন্দ্রনাথের একটি মূর্তি, তার পেছনে একটি শৌখিন ট্রে। ট্রের মাথার কাছে একটা টিকটিকি, আর একটা আরশোলা। দেখলে জীবন্ত মনে হয়, কিন্তু মাটির। বুদ্ধ-গয়া, শিব-লিঙ্গ, ধূপদানি, ফটো-ফ্রেম, ভুঁড়ি-বার-করা ন্যাড়া মাথা বিকশিত দন্ত একটা লোক, কাঠের তৈরি ড্রাগন, তারপরই পেঁচা একটা। ঠিক তার উপরে তিনটি অহিরিণী গোয়ালিনীর অপূর্ব মৃন্ময় মূর্তি, মাথায় দুধের কেঁড়ে নিয়ে হাত দুলিয়ে চলছে সদর্পে। ফুলদানিই কত। পাথরের, মাটির, কাচের, পিতলের, চীনেমাটির। তার পাশেই রেঙ্গুন থেকে আনা লেকারের জিনিস, ফুলদানি, কৌটো, চায়ের ট্রে। তার অধারে চীনে-ধাঁচের বুদ্ধমূর্তি। তার পাশেই একটা কাপ, আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণদেব আর শ্রীশ্রীমায়ের ফটোও রয়েছে। তাঁদের সামনে রঙিন ছোট ছোট থালায় কন্যাকুমারী থেকে আনা পাথরের চাল, আর নুড়ি রয়েছে নানারকম। নানা রঙের ঝিনুক এবং সামুদ্রিক শামুকের খেলাও। কোণে মোড়া রয়েছে কাগজের রঙিন পাখিটি। আরও কত জিনিস- ছোট ছোট কাপ, ছোট ছোট পাখি, মাটির ফল, কাঠের নেপালি ফুলদানি। তার পিছনে গণেশ।...
ভুটান আর জাম্বু-কুকুর দুত-মুখ শুকিয়ে বসে আছে থাবার ওপর মুখ রেখে। কোথায় গেল!
সদ্য বিবাহিত কন্যা সব ফেলে রেখে চলে গেছে শ্বশুরবাড়ি। এখানকার একটি জিনিসও আর দরকার নেই তার। নতুন জায়গায় নতুন জিনিস নিয়ে নতুন সংসার পেতেছে।
চারদিকে তার স্মৃতিচিহ্ন দেখে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ওগুলো যেখানে যেমন আছে থাক। দেখে কষ্ট হচ্ছে বটে, কিন্তু এই কষ্টটাই মিষ্টি। এই মাধুর্যের সম্বলই তো একমাত্র সম্বল।
-সংকলিত