‘হে মানুষ! তোমাদের প্রভুকে ভয় করো। অবশ্যই কেয়ামতের কম্পন খুবই কঠিন। সেদিন দুগ্ধপোষ্য মা তার সন্তানের কথা ভুলে যাবে। ভয়ে গর্ভবতীর গর্ভপাত হয়ে যাবে। প্রতিটি মানুষ মাতালের মতো টলতে থাকবে, কিন্তু তারা কেউই নেশাগ্রস্ত নয়। সাবধান! আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত ভয়ংকর।’ (সুরা হজ, আয়াত ১-২)।
কেয়ামতের বড় আলামতগুলোর একটি ভূমিকম্প। সম্প্রতি প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে যে ভূমিকম্প পুরো দেশবাসীকে স্তম্ভিত করেছে, কেয়ামতের ভূমিকম্পের তুলনায় তা শিশুর খেলনা বললেও ভুল হবে না। কেয়ামতের ভূমিকম্প যখন তীব্র মাত্রা ধারণ করবে তখন পৃথিবীর যত বড় বড় অট্টালিকা আছে সেগুলো তো মাটির সঙ্গে মিলিয়ে যাবে, পাশাপাশি পৃথিবীর যত বড় বড় পর্বত আছে, সব তুলার মতো শূন্যে উড়তে থাকবে। কোরআনের ভাষায়, ‘হঠাৎ মহাপ্রলয়! কী ভয়াবহ মহাপ্রলয়! তুমি কি ধারণা করতে পারো মহাপ্রলয় কী? সেদিন মানুষ বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মতো চারদিকে নিক্ষিপ্ত হবে। পর্বতমালা উড়ে যাবে পেঁজা পেঁজা ধুনা তুলার মতো’ (সুরা আল কারিয়াহ, আয়াত ১-৫)।
আল্লাহর বড় আজাব যেমন কঠিন, তেমনি ছোট আজাবও ছোট নয়। দুনিয়ার তাবৎ গবেষকরা হয়রান, ৯ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে সে ভাবনায়। কিন্তু কেয়ামতের ভূমিকম্প যে কত মাত্রায় হবে তা হয়তো রিখটার স্কেলে মাপাও সম্ভব হবে না। গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পটি ছিল ৬ মাত্রারও কম। এতেই আমাদের সবার অন্তরে ভয় ঢুকে গেছে। তাহলে কেয়ামতের ভূমিকম্পের দৃশ্যের মুখোমুখি যারা হবেন, তাদের কী অবস্থা হবে কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে।
তাফসিরে মাজহারিতে আল্লামা কাজী সানাউল্লাহ (রহ.) লিখেছেন, আল্লাহতায়ালা বান্দাকে ভূমিকম্প সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন। তার আগে বলে দিয়েছেন, হে মানুষ! তোমার প্রতিপালককে ভয় করো। এ থেকে বোঝা যায়, কেয়ামতের কঠিন ভূমিকম্প থেকে বাঁচার একটাই পথ- আল্লাহকে ভয় করে তাঁর দেখানো পথে চলা। তাহলেই কেবল কেয়ামতের পাহাড়-পর্বত উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ভয়ংকর ভূমিকম্প থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে। একবার চিন্তা করুন! এত কঠিন ভূমিকম্প থেকেও যদি তাকওয়াবান বান্দারা বাঁচতে পারে, তাহলে ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প তো মুত্তাকিদের জন্য কোনো চিন্তার কারণই হবে না।
এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন। মুত্তাকি বান্দামাত্রই ভূমিকম্প থেকে বেঁচে যাবে এটা যেমন সত্য, আবার অনেক তাকওয়াবান বান্দাও ভূমিকম্পে মারা যান এটাও ঠিক। তার মানে কি মুফাসসিরগণ দ্বিমুখী কথা বলছেন? মোটেও তা নয়। এখানে বোঝার ব্যাপার আছে। ভূমিকম্প একটি আজাব কোনো সন্দেহ নেই। আর ভূমিকম্পের ভয় সেটাও পৃথক আরেকটি আজাব। যারা মুত্তাকি, তারা ভূমিকম্পের ভয়ে ভীত থাকে না। কখন ভূমিকম্প হবে, কখন সব ভেঙে যাবে এ চিন্তায় তারা ট্রমায় পড়ে যায় না। বরং তারা সব সময় আল্লাহর ওপর ভরসা করে সাবধানতা অবলম্বন করেন। আল্লাহ তাকদিরে যা রেখেছেন তাই হবে এই ভেবে তারা মানসিকভাবে নিশ্চিন্ত আনন্দের জীবন কাটান। তার মানে, মুত্তাকিমাত্রই ভূমিকম্পের আতঙ্ক থেকে বেঁচে যায়। এটা হলো একটি দিক। আরেকটি দিক হলো, মুত্তাকি বান্দার যদি হায়াত অবশিষ্ট থাকে, তাহলে আল্লাহর কুদরতে কোনো না কোনোভাবে সে ভয়ংকর ভূমিকম্প থেকেও বেঁচে যাবেই। দেখা গেল, বাড়ির সবাই মারা গেছে, কেবল একজন বেঁচে আছে। এটা হয়ে থাকে আল্লাহর কুদরতে। আর যদি কোনো বান্দার মৃত্যু ভূমিকম্পে লেখা থাকে তাহলে সে মুত্তাকি হওয়া সত্ত্বেও ভূমিকম্পেই মারা যাবে। অর্থাৎ ভূমিকম্প থেকে বাঁচার আমল হলো, তাকওয়ার জীবনযাপন করা। তাকওয়ার জীবন যারা যাপন করবে তারা ভূমিকম্পের আতঙ্ক থেকে বেঁচে যাবে। আর হায়াত থাকলে ভূমিকম্প থেকেও বেঁচে যাবে। তার মানে যারা ভূমিকম্পে মারা যায়, তাদের মধ্যে মুত্তাকি বান্দা নেই এমনটাও কিন্তু বলা হচ্ছে না। আরেকটা উদহারণ দিয়ে বোঝানো যাক। আল্লাহ বলেছেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহর। তিনি জানেন পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণের আয়ুষ্কাল কী হবে এবং মৃত্যুর পর তার স্থান কোথায় হবে। সবকিছুই সুস্পষ্ট লিপিকায় লিপিবদ্ধ রয়েছে’ (সুরা হুদ, আয়াত ৬)। এখানে বলা হয়েছে, প্রতিটি জীবের রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর। এ সত্ত্বেও আমরা দেখি পৃথিবীর বহু প্রাণী এমনকি মানুষও না খেয়ে তিলে তিলে মারা যায়। এর কারণ কী? কারণ পরের আয়াতেই বলা হয়েছে, তার হায়াত ও মওতের বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করে কিতাবে লেখা আছে। রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর এটা যেমন ঠিক আবার কারও মৃত্যু যদি লেখা থাকে না খেয়ে মরতে হবে, তাহলে তার রিজিক বন্ধ করে দেওয়াও আল্লাহর সিস্টেমেরই অন্তর্ভুক্ত। একইভাবে মুত্তাকিরা কেয়ামতের কঠিন ভূমিকম্পসহ সব ধরনের আসমানি গজব থেকে বেঁচে থাকবেন এটা সাধারণ আইন। তবে যদি কোনো কারণে তারা সে আজাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, বুঝতে হবে এটা তাকদিরের লেখন। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দিন। আমিন।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট