১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। বাংলাদেশের নাটোর জেলায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনের আয়োজন করা হয় ১০, ১১ ও ১২ জুন পর্যন্ত। নাটোরের রানী ভবানীর রাজবাড়ি থেকে কিছু দূরে দিঘাপতি যাওয়ার পথে একটি বিশাল মাঠে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। নাটোরের মহারাজ জগবিন্দ্রনাথ এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কলকাতা থেকে আসেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে অরবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেবি প্রসাদ সর্বাধিকারি, মহেন্দ্রনাথ রায়, হেমচন্দ্র রায়, চারুচন্দ্র মিত্র, আনন্দমোহন বসু, মৌলভী মোহাম্মদ জাহিদ, কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, আবুল কাসেম প্রমুখ। এ ছাড়া সেদিন উপস্থিত ছিলেন চৌগাছার জমিদার রজনী কান্ত রায়, দিঘাপতির জমিদার বসন্ত কুমার রায়, পুটিয়ার রাজা গোপাল চন্দ্র রায়, কাসিমপুরের জমিদার কেদার প্রসন্ন লাহিড়ী, নাটোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিশোরী মোহন চৌধুরীসহ আশপাশের জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। ১২ জুন বিকাল ৫টার দিকে ভূমিকম্পের আগ মুহূর্তে বক্তব্য দিচ্ছেন আবুল কাসেম। তাঁর বক্তব্য শেষ হওয়ার পরে কংগ্রেস প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হবে সেই সময় ভূমিকম্প শুরু হয়। শ্রোতা-বক্তা সবাই ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় মঞ্চ থেকে উমেশ চন্দ্র নামে একজন উপস্থিত লোকজনকে শান্ত থাকতে বলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মানুষ ছুটতে শুরু করে। অতিথিদের মধ্যে কয়েকজনকে রাখা হয়েছিল শকুন জমিদারের বাগানবাড়িতে। বাকি অতিথিদের রাখা
হয়েছিল দিঘাপতিয়ার রাজবাড়িতে। ভূমিকম্পের পরে সন্ধ্যায় কলকাতা থেকে আসা অতিথিরা কলকাতা যাওয়ার জন্য নাটোর রেলস্টেশনে যান। সেখানে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন নাটোর রেলস্টেশনের কয়েক মাইল দূরে একটি ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় অতিথিরা নাটোরে থাকতে চাইলেন না। পরে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়, কলকাতার বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তি এসেছেন। তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছানো জরুরি। কয়েক ঘণ্টা পরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজের ওপারে একটি ট্রেন আসে। অতিথিরা হেঁটে নাটোর রেলস্টেশন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজের কাছে যান। ব্রিজের ওপারে ট্রেনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দলবল নিয়ে কলকাতা চলে যান। ভূমিকম্পে নাটোর রাজবাড়ির দুটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রাণে বেঁচে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অন্যরা। কারণ সে সময় তাঁরা মাঠে ছিলেন। সেই ভূমিকম্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবিঠাকুরের নাম। ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ৭ মিনিট। সেদিনের ভূমিকম্পে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে কমপক্ষে ২৫টি নদনদী গতি হারিয়েছিল। সেসব নদী এখন শীর্ণ আকারে অর্ধমৃত অবস্থায় প্রবাহিত হচ্ছে।
ভূমিকম্পের ফলে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় ফাটল দেখা দেয়। আবার কোথাও কোথাও ৫ থেকে ৭ ফুট গর্তের সৃষ্টি হয়। গর্ত থেকে নির্গত বালু এবং পানি জলাশয় ও নিম্নভূমির গভীরতা হ্রাস করে। হাজার হাজার একর চাষের জমি অযোগ্য হয়ে পড়ে। এ সময় বহু সরকারি-বেসরকারি ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। সে সময়ের ভূমিকম্পে বৃহত্তর রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের অনেক নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা কমে যায়। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরীর গিরাই নদী, উলিপুরের বামনি ও বুড়ি তিস্তা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সরাই ও মানাস নদী, গোবিন্দগঞ্জের নাহালিয়া ও আখিরা নদী ও রংপুর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ঘোষ খাল যা বর্তমানে শ্যামাসুন্দরী খাল হিসেবে পরিচিত প্রায় ভরাট হয়ে যায়। এ ছাড়া রাজাশাহী বিভাগের বরাল, করতোয়া, চলনবিলের ছয়টি নদী, খালিসাডাঙ্গিসহ আরও বেশ কয়েকটি নদী তার চলার নিজস্ব গতি হারিয়ে ফেলে।
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের পর থেকেই উত্তরাঞ্চলের ভূপ্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সে সময়ের ভূমিকম্পের পর ১৯১৬ সালে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। তবে সে সময় নদনদীর আকৃতি পরিবর্তনে কোনো প্রভাব ফেলেনি। এর আগে ১৭৭৫ সালেও বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। এতেও নদনদীর তেমন একটা ক্ষতি হয়নি।
লেখক : সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রতিদিন