ছেলের পিএইচডি করা উপলক্ষে হঠাৎ করেই আসতে হলো মালয়েশিয়া, তা-ও দীর্ঘদিনের জন্য। কখনো ভাবিনি জীবনের শেষ অংশে এভাবে দেশ ছাড়ব আমি। দেশ ছাড়ার হলে অনেক আগেই ছাড়তে পারতাম। বিস্তর সুযোগ এসেছিল জীবনে। বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হওয়ার অনেক হাতছানি অক্লেশে ত্যাগ করেছি। বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকার কথা আমি ভাবতে পারি না। দুই-চার দিন, বড়জোর দুই-এক মাস বেড়াতে ভালো লাগে, এর বেশি না। এবার তিন বছরের মামলা। পরিস্থিতি অনুকূল হলে এটা এক বছরও হতে পারে। অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। ছেলে বউমা আর নাতিকে নিয়ে যাবে। কাজেই একা আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। আমার পায়ের নখ থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত জটিল জটিল রোগ। একা থাকার উপায় নেই। ছেলে রাখবে না, তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আসতে হলো বাড়িঘর ফেলে রেখে।
মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের যে বিমানে এলাম, সেটা মোটেই জুতসই মনে হলো না। শুনেছিলাম হুইলচেয়ার প্যাসেঞ্জারদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। কার্যত সেটা দেখলাম না। রাতের ফ্লাইট সব সময়ই কষ্টের। একবিন্দু ঘুম হয় না। এবারও হলো না। সকাল ৮টায় কুয়ালালামপুর পৌঁছালাম। পান্থ ছুটে এলো। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের বাসা এক ঘণ্টারও ওপরে। রাস্তায় প্রচুর গাড়িঘোড়া দেখলেও একজন মানুষও দেখলাম না। হতে পারে খুব সকাল আর হাইওয়ে বলে কারও দেখা পেলাম না।
এয়ারপোর্টে বহুবার চেকিংয়ের মুখোমুখি হলাম আমরা। যেমন ঢাকা এয়ারপোর্টে তেমনই কুয়ালালামপুরে। আগেই শুনেছিলাম এখানে বাংলাদেশি শ্রমিক বেশি বলে এরা বাংলাদেশিদের নীচু চোখে দেখে। আমাকে একজন বাঙালি মেয়ে বলেছিল, সে ট্রেনে যাচ্ছিল। পাশে বসা মালয়ি ভদ্রমহিলা বারবার তাঁর ব্যাগ দেখছিলেন। তিনি বোধ হয় ভাবছিলেন ওই বাঙালি মেয়েটি তাঁর ব্যাগ থেকে কিছু ছিনতাই করে নেবে। এমন একটা ধারণা মালয়দের মধ্যে আছে। মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাঙালিদের বড় অংশ শ্রমিক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী। বর্তমানে বাংলাদেশিদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়া। প্লেনে আশপাশে প্রচুর শ্রমিককে দেখলাম। সবাই এসেছে এখানে কাজ করতে, জীবনমান ফেরাতে। মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। দেশটি যেমন উন্নত, তেমনি বাংলাদেশিদের জন্য কর্ম ও শিক্ষার সম্ভাবনায় ভরপুর। দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের বড় বাজার। প্রায় ৫ থেকে ৮ লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত। কেউ নির্মাণশিল্পে, কেউ কারখানায়, কেউ রেস্টুরেন্ট, হোটেল, শপিং মল পরিবহন কিংবা কৃষি খাতে। আছে কাজ করছে ভালো কথা, কিন্তু কেমন আছে বাংলাদেশিরা? বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক বছরেরও কম সময় পর। মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম দিকের দেশগুলোর একটি, যারা স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতামূলক।
সম্পর্কের প্রধান দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১. শ্রম ও অভিবাসন : মালয়েশিয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের অন্যতম গন্তব্য যা আগেও বলেছি। নির্মাণ, শিল্প, কৃষি ও পরিষেবা খাতে লাখ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত। শ্রমিক পাঠানো ও তাদের অধিকার রক্ষায় দুই দেশের মধ্যে একাধিক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে।
২. বাণিজ্য ও বিনিয়োগ : দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ মালয়েশিয়া থেকে মূলত পাম তেল, যন্ত্রাংশ ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি করে, আর মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করে তৈরি পোশাক, পাটজাত দ্রব্য ও খাদ্যপণ্য।
মালয়েশিয়ার কিছু বড় কোম্পানি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, নির্মাণ ও টেলিকম খাতে বিনিয়োগ করছে।
৩. শিক্ষা ও সংস্কৃতি : মালয়েশিয়ায় কয়েক হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। এই শিক্ষাসহযোগিতা দুই দেশের সম্পর্ককে মানবসম্পদ উন্নয়নের দিক থেকে আরও গভীর করেছে।
এ ছাড়া সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান, পর্যটন সহযোগিতা ও মুসলিম ঐক্য রক্ষায় দুই দেশ একই প্ল্যাটফর্মে কাজ করছে।
৪. কূটনৈতিক সহযোগিতা : কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশন এবং ঢাকায় মালয়েশিয়ার হাইকমিশন দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রবাসী সেবা পরিচালনা করছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দুই দেশ জলবায়ু পরিবর্তন, শান্তিরক্ষা ও উন্নয়ন সহযোগিতায় একে অপরকে সমর্থন করে থাকে।
আমাদের প্রবাসী আয়ের এক বড় অংশ আসে মালয়েশিয়া থেকে। আনেন আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা। তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করেন, দক্ষ, শৃঙ্খলা মেনে চলেন। তাই তাঁরা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। মালয়েশিয়ার উন্নয়নে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য, তাঁরা উন্নয়ন কাঠামোর অন্যতম চালিকাশক্তি। তাঁরা দিনরাত কাজ করেন অক্লান্ত। শরীরের ঘাম ঝরিয়ে তাঁরা পরিবার ও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।
শ্রমিক ভাইরা খুব সকালে কাজ শুরু করেন, ফেরেন সন্ধ্যায়। তখন তাঁরা ক্লান্ত বিধ্বস্ত। সেই ক্লান্তির মাঝেও তাঁরা দেশে কথা বলেন নিয়মিত, পরিবারের খবরাখবর নেন। পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই তাঁদের এই কঠোর পরিশ্রম।
তবে কথাগুলো যত সহজভাবে বললাম তত সহজ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতা নির্মম। অনেকে অনিয়মিত এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় এসেছেন। প্রতারণার শিকার হয়েছেন। যে শর্তে এসেছেন সে শর্ত পূরণ করেনি এজেন্সির লোকরা। যে চাকরি পাওয়ার কথা ছিল তা পাননি। অনেক বেশি টাকা খরচে করে এসেও কেউ কেউ কম বেতনের চাকরি পেয়েছেন। কেউ কেউ বেতন না পেয়ে মাসের পর মাস মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। অনেকের বৈধ কাগজপত্র হারিয়ে গেছে। অবৈধ অবস্থায় লুকিয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে দিন কাটান তাঁরা। অনেকেই দালালের প্রতারণার শিকার হয়ে বিপুল খরচে মালয়েশিয়ায় এসেছেন, কিন্তু চাকরি পাননি। চরম বিপাকে পড়েছেন।
তবু হাল ছাড়েননি তাঁরা। কেউ ছোটখাটো ব্যবসা করছেন, কেউ দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। ভালো চাকরির আশায় অবিরাম সংগ্রামের মধ্যে আছেন।
নির্মাণশিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করেন। নিরাপত্তাহীনতা, দুর্ঘটনা এবং চিকিৎসাসুবিধার অভাব যেন তাঁদের ভাগ্যের লিখন, তাঁদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার ‘রিহায়ারিং প্রোগ্রাম’ ও ‘লিগ্যালাইজেশন স্কিম’ চালু করেছে। এর ফলে অনেক অবৈধ কর্মী বৈধ হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। খানিকটা স্বস্তি এসেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনে।
বিদেশের জীবন মানেই সীমাহীন নিঃসঙ্গতা। একা থাকা, পরিবারপরিজন থেকে দূরে থাকা। ফলে বাংলাদেশিরা মানসিক চাপে থাকেন। এই একাকিত্ব কাটানোর জন্য তাঁরা সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তাঁরা একে অপরকে সহায়তা করার চেষ্টা করেন। দেশীয় সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করেন। ঈদ বা পয়লা বৈশাখের মতো উৎসবগুলো প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য মিলনমেলা হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়া থেকে বছরে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে। এই অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাড়িঘর তৈরি, সন্তানদের শিক্ষা, কৃষিকাজ বা ছোট ব্যবসায় এই রেমিট্যান্স বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
প্রবাসীদের জীবন সহজ, সুন্দর ও ঝুঁকিমুক্ত করতে দূতাবাস ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা থাকা দরকার। প্রতারক দালালদের দমন, বৈধ নিয়োগপ্রক্রিয়া, শ্রমিকদের সুরক্ষায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নেওয়া খুবই জরুরি।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা সংগ্রামের এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও কর্মপ্রয়াস দিয়ে প্রমাণ করেছেন পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় তাঁরা জায়গা করে নিতে সক্ষম। শ্রমিকদের পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় এখন কয়েক হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী পড়াশোনা করছেন।
এখানকার শিক্ষাখরচ তুলনামূলকভাবে কম, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভালো, পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজের সুযোগ আছে। ফলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে মালয়েশিয়া জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
তবে শিক্ষার্থীদের জীবনেও চাপ কম নয়। রয়েছে নানা রকম চ্যালেঞ্জ। টিউশন ফি ও বাসাভাড়া অনেকের জন্য বড় চাপ। অনেকেই পার্টটাইম কাজের ওপর নির্ভর করেন, কিন্তু সহজে কাজ পাওয়া যায় না। অনেকের বৈধ কাজের অনুমতি নেই। তাঁরা পড়েন বিপাকে। অনেকেই পড়াশোনা শেষে মালয়েশিয়ায় চাকরির চেষ্টা করেন। কেউ কেউ দেশে ফিরে যান। নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কাজ খুঁজে নেন। এই তরুণ প্রজন্ম আমাদের সম্পদ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার বৈধতা ও শ্রমবাজার সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষ কর্মী পাঠানোর পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষা খাতেও দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা বাড়ছে, যা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আরও সুযোগ তৈরি করবে।
তবে শ্রমিকরা যেন প্রতারণার শিকার না হয়, ন্যায্য মজুরি পায়, শিক্ষার্থীরা যেন প্রতিশ্রুতি/শর্ত অনযায়ী সুযোগসুবিধা পায় সে দিকটা নিশ্চিত করা যথাযথ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।
লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক